গত ৮ মার্চ শৈলী প্রকাশনার উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত গেলো শৈলী লেখক সম্মিলন’। সকাল সোয়া দশটা থেকে বেলুন উড়িয়ে উদ্বোধন, এরপর দিনব্যাপী শৈলীর বিভিন্ন প্রকাশনা যেমন প্রবন্ধ ও গবেষণা প্রকাশে শৈলী, কবিতা ছড়াপাঠ, গল্প উপন্যাস প্রকাশনায় শৈলী, ছোটদের বই প্রকাশনায় শৈলী, তরুণ লেখকদের বিশ্বস্ত ঠিকানা শৈলী এবং আমাদের জন্য ছিলো চমৎকার একটি বিষয় তা হলো– ‘নারী লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতায় শৈলী’। বিকেল সাড়ে ৪টায়। যদিও সময় একটু পিছিয়ে ছিলো তবুও আমাদের জন্য অনুষ্ঠানটি ছিলো অত্যন্ত মনকাড়া। শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে সারাদিনের অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি হয়। যাকে বলে মধুরেন সমাপয়েৎ।
এবারে আমি আমাদের কথায় আসছি। কাকতালীয়ভাবে সেদিন দিলো ৮ মার্চ নারী দিন। এর পূর্ব দিন ছিল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন। আসছে ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস। সবশেষে ২৬ শে মার্চ– আমাদের স্বাধীনতা দিবস। সব মিলিয়ে মার্চ মাসের মত গুরুত্বপূর্ণ এমন মনকাড়া অনুষ্ঠানের হোতা শৈলী প্রকাশনের দুই কর্ণধার যথাক্রমে রাশেদ রউফ এবং আয়েশা হক শিমুকে অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। রাশেদ আমার অনুজ সম, তাই বলি যথাসময়ে ঠিক কাজটি করার বেলায় সে অত্যন্ত তৎপর। সেদিনের সেই মিলনমেলাটি ছিলো অত্যন্ত আনন্দমুখর এবং যথার্থ ও সার্থক। আর তাই, ‘নারী লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতায় শৈলী’র পর্বে মঞ্চে ছিলাম আমরা সব নারী। সঞ্চালনায় ছিলেন আর এক গুণী বাচিক শিল্পী আমাদের সবার প্রিয় আয়েশা হক শিমু। মুখবন্ধ হিসেবে রাশেদ একটু বলেই শিমুকে দাড় করিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলেন। এরপর কবি মর্জিনা আখতার সূচনা বক্তব্য দিলো অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। আমাদের অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর রীতা দত্ত। যাঁরাই ছিলেন সেদিনের মঞ্চ আলোকিত করে শৈলী প্রকাশন থেকে তাদের সবার একের অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে।
এটি যেহেতু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়–সেহেতু আলোচকদের নাম বলতেই হয়। এঁরা ছিলেন কবি ও গল্পকার কবি ফরিদা ফরহাদ, কবি ও সঙ্গীতশিল্পী মৃণালিনী চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক কাঞ্চনা চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক ফেরদৌস আরা রীনু, কবি ও গল্পকার লিপি বড়ুয়া, কবি ও ফ্যাশন ডিজাইনার সুলতানা নূর জাহান রোজী এবং আমি। এই আনন্দমুখর অনুষ্ঠানে সবাই একবাক্যে তাদের সাহিত্য চর্চা ও প্রকাশনায় শৈলী প্রকাশনের বিভিন্ন সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তাদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানান। এই প্রসঙ্গে আমার উপলব্ধি ছিলো একই রকম। শৈলীর কর্ণধার অত্যক্ত সতর্কতা ও আন্তরিকার সাথে লেখকের লেখকসত্তাকে বের করতে তৎপর থাকেন এবং প্রকাশনায়ও সহায়তা করেন।
একটা সময় ছিলো চট্টগ্রামের সাহিত্যে নারীর প্রকাশনার অন্যতম প্রেক্ষাপট ছিলো দৈনিক আজাদী। সেই সময়ে যাঁরা লিখে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সুনাম কুড়িয়েছেন, যাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় নারী সাহিত্যিক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সেই তাঁরা যেমন সালমা চৌধুরী, বেগম ফাহমিদা আমিন, বেগম রুনু সিদ্দিকী, ফজিলতুল কদরসহ আরও অনেকেই। এঁরা সবাই দৈনিক আজাদীর পাতায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। বই প্রকাশের বেলায় এরা শৈলী প্রকাশনার দ্বারস্থ হয়েছেন। যশস্বী হয়েছেন। এঁরাই আমাদের অহংকার। এরপরও অগণিত নারী লেখক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন এবং করছেন। ড. আনোয়ারা আলম, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা প্রমুখ। আমি যদি নাম বলতে চাই তাহলে বিরাট তালিকা হয়ে যাবে। ঐ দিন মঞ্চে যাঁরা ছিলেন সুলতানা নুরজাহান রোজী তাঁদেরকে শৈলীর প্রোডাক্ট হিসেবে অভিহিত করেন। আর তাই বলবো শৈলীর পৃষ্ঠপোষকতার তুলনা কেবলই শৈলী। এখন সাহিত্যের অঙ্গনে নারীরা এগিয়ে এসেছেন বহুভাবে। তারা লিখছেন আরও লিখবেন। চট্টগ্রামে প্রকাশনা সংস্থাও আনেক বেড়েছে। তবে নারীদের জন্য শৈলী একটি বিরাট ভরসা ছিলো, আছে এবং থাকবে আশা করি। শুধু লেখালেখি বই প্রকাশই নয়। পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারেও শৈলীর উদার মনোভাবের জন্যই আজ মাসিক নারীকণ্ঠ, অনন্য ধারা সহ অনেকেই সহযোগিতা পেয়েছে। ঋদ্ধ হয়েছে। এগুলো সবই মাইলফলক। শৈলীর আড্ডা একটি চমৎকার সৃষ্টিশীল আড্ডা। এই আড্ডার নেপথ্যে কত শত লেখনী ও প্রকাশনা। আরও বলতে হয়, এই আড্ডার হোতাদের নিয়েই একদিন গঠিত হলো চট্টগ্রাম একাডেমি। যা আজ মহীরুহ।
একদিন যাঁরা শৈলীর আড্ডায় জমাটভাবে মেতেছিলেন আজ তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম একাডেমিকে আলোকিত করে রেখেছেন। আর একটি কথা না বললেই নয়, তাহলো রাজধানী এবং দেশের অন্যান্য স্থান থেকে যত পুরস্কার আমাদের চট্টগ্রামের ভাগে এসেছে তার বেশিরভাগ পুরস্কৃত বই ও লেখক শৈলী ও একাডেমির সাথে সংযুক্ত। এটাও শৈলীর জন্য একটি অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার বলে মনে করছি। বর্তমানে লেখালেখি সাহিত্য চর্চা অনেক বেড়েছে। তুলনা করতে গেলে দেখা যাবে পূর্বের তুলনায় নারী সাহিত্যিকের সংখ্যাও বেড়েছে। সেই তুলনায় প্রকাশনী সংস্থাও বেড়েছে। তবু মনে করছি, পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে বিজ্ঞ এবং নতুন নারী সাহিত্যিকদের লেখার নেপথ্যে রয়েছে শৈলী প্রকাশন। এবং হয়তো সংখ্যায়ও অনেকের তুলনায় বেশি। আশা করি, শৈলী এভাবেই থাকবে তার মানবিকতা, সহৃদয়তাও অক্ষুণ্ন থাকবে পূর্বাপর। আমরা চট্টগ্রামের সাহিত্যকর্মী নারীরা যেন হাত বাড়ালেই শৈলীকে পরিপূর্ণভাবে পাই। প্রত্যাশা শৈলী সকল সাহিত্যকর্মীদের সফলতার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে তার অনবদ্য সহায়তার হাতকে সচল ও প্রসারিত রাখবে আগামীতেও। সবার মঙ্গল কামনা করছি।
লেখক : সভানেত্রী, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ।