সামাজিক অস্থিরতা, মানবিকতাহীন ও অসহিষ্ণুতা যেন দিনদিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখেছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। ফলে মানুষ সুযোগ পেলে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নানাভাবেই সে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য–এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অমানবিক ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। শুধু শহরে নয়, গ্রামের মানুষের মধ্যেও আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব বাড়ছে। কেউ কারও বাড়ির উঠোন মাড়ান না। ঘরে দরজায় টোকা দেওয়া তো পরের কথা। অথচ একসময় গ্রামে ভোরে ঘরের দরজা খোলা হতো আর রাতে ঘুমানোর আগে তা বন্ধ হতো। এখন সেদিন নেই। আর এ ইটপাথরের শহরে তো দুজন মানুষ বছরের পর বছর একই ভবনে থাকেন অথচ তারা কেউ কাউকে চেনেন না। এভাবে নিজের অজান্তেই আমরা একটি স্বার্থপর, ভয়ের সংস্কৃতির, সংক্ষুব্ধ ও আত্মকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজের একেকজন সদস্য হয়ে পড়ছি। এখানে কুশল বিনিময়, চোখে চোখ রেখে ভাব বিনিময় অনেক পরের কথা, সালাম বিনিময়ও হয় না। এটি একটি সামাজিক রূপান্তর। এ রূপান্তর আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে? তবে এমন একটি নাগরিক সমাজ দিয়ে একটি মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়।
সমাজের মূল ভিত্তি সম্পর্ক। সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এবং টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব প্রত্যেকের সমান। সমাজের একজন সদস্য হিসেবে আমরা কেউই এর দায় এড়াতে পারি না। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এমন মনোভাব থাকতে হবে যে সমাজ আমাদের এবং একে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের। আমাদের মধ্যে ভালো ও খারাপ উভয় গুণই থাকবে। কারো মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলিও ভালো–খারাপ হবে। কিন্তু খারাপ গুণাবলি ও আচরণকে ভালোর দিকে নিয়ে আসার জন্য সমাজে থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। মিলেমিশে থাকাই সমাজের মূল লক্ষ। কিন্তু আমরা যদি একাধিক প্রতিপক্ষ তৈরি করি এবং সংঘাতে লিপ্ত হই, তাহলে সমাজের ভিত্তি দুর্বল হবে এবং সংগত কারণে তা হচ্ছে। আমাদের পারিবারিক শিক্ষা আজ অনেকটা কমে যাচ্ছে। ফলে আমাদের মধ্যে অতিমাত্রায় ইগো কাজ করছে। অন্যের কথা, মতামত, মত প্রকাশ, দৃষ্টিভঙ্গি সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিত ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে–এমন আত্মবিশ্বাস খুব কম মানুষেরই আছে। জোর যার মুল্লুক তার,এমন সমাজে বিচারহীনতা থাকে। কদাচিৎ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলেও বিচারহীনতাই এমন সমাজে স্থায়ীভাবেই প্রতিষ্ঠিত।
আগেকার দিনে দেখা যেত গ্রামে যে সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, সেখানে একজন সমাজপতি বা মাতব্বর থাকতেন। তাকে সবাই সমাজের সবচেয়ে বুঝমান ব্যক্তি মনে করতেন। অন্য সবাই তাকে মেনে চলতেন। তিনি কিছু করতে বললে সবাই সেভাবে কাজ করতেন। সে কারণে সমাজে অনেকটা শান্তি–শৃঙ্খলা বজায় থাকত। কোনো কাজ করতে গেলে আগে গ্রামের লোকজন সেখানকার মুরব্বি ও মোড়ল মাতব্বরদের পরামর্শ নিতেন। ছোটরা বড়দের পরামর্শ নিয়ে কোনো কাজ করতেন। সামাজিক নিয়মকানুন, শান্তি–শৃঙ্খলার দিকে সবাই বেশি গুরুত্ব দিতেন। কোনো কাজে যেন বিশৃঙ্খলা না ঘটে, সেদিকে নজর রেখে ময়মুরব্বিদের কথা মেনে চলতেন। অপরের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। সবাই কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন। এতে সমাজে সবার মঙ্গল সূচিত হতো। মানুষ নিরাপদে, শান্তিতে, আনন্দের মধ্য দিয়ে সমাজে বাস করার সার্বিক পরিবেশ পেত।
বর্তমানে মধ্যবিত্তের অনেকেই নেমে গেছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর্থিক অসঙ্গতি সাধারণের মধ্যে সার্বক্ষণিক চাপা ক্ষোভ তৈরি করছে। কাঙিক্ষত জীবন অর্জনে ব্যর্থতা সমাজে তৈরি করছে অসম প্রতিযোগিতা। বেকারত্ব সৃষ্টি করছে হতাশা। একই সমাজে উচ্চ শ্রেণির বর্ণাঢ্য জীবন নিম্নবিত্তকে ঈর্শাকাতর করছে। প্রেমে পরাজয় জন্ম দিয়েছে প্রতিহিংসার। ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে বেড়েছে উন্মাদনা। অযোগ্য ব্যক্তির উত্থান এবং যোগ্যতমের পতনে তৈরি হয়েছে বিভেদ। সমাজের এই অসম বাস্তবতা সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। তারা মানসিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মানবিকতা ও অসহিষ্ণুতা।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, শহরে–গ্রামে সামান্য কারণে কাউকে হত্যা করা হচ্ছে। এই অসহিষ্ণুতা হওয়ার অন্যতম কারণ হলো বিচারহীনতা। বর্তমানে অনেক হত্যা ও সহিংসতার মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, বিচার হয় না, কিংবা প্রভাবশালী অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাই অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। পাবলিক স্পেসে সিসি ক্যামেরা বাধ্যতামূলক করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে পুলিশ ও প্রসিকিউশনের জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেন বিচার কেবল একটি কাগজে আটকে না থাকে।
শহর ও গ্রামে শান্তি রক্ষার একটি বড় মাধ্যম হলো পরস্পরের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক। আগে শহরে ও গ্রামের এলাকার বড় ভাই বা স্থানীয় মাতব্বররা ঝগড়াঝাঁটি থামাতেন। এখন এই ভূমিকা হারিয়ে গেছে। তাই নতুনভাবে পাড়া কমিটি, শহুরে কমিটি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে শান্তির জন্য কমিটি গঠন করতে হবে, যারা আগাম মধ্যস্থতার মাধ্যমে ছোট ছোট দ্বন্দ্ব থামাতে পারবে। তারা কেবল বিরোধ মেটাবে না, বরং আলোচনার পরিবেশও তৈরি করবে, যা সমাজে বোঝাপড়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। পুরোনো সমাজ ব্যবস্থায় গেলে অসহিষ্ণুতা কমবে বলে মনে হয়।
লেখক : শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যলেখক