আবদুল্লাহ আল নোমান : এক পরিশীলিত রাজনীতিবিদ

ডেইজী মউদুদ | শুক্রবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনাকাল। আমি সম্ভবত প্রাইমারি স্কুলে অটোপাস নিয়ে নতুন ক্লাশে ভর্তি হয়েছি। নতুন দেশ হলেও কেমন যেনো উত্তাল উত্তাল ভাব দেশজুড়ে। তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের একটি গ্রুপ (ভাসানী ন্যাপ) অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে তারা সদা মাঠে ময়দানে থাকতেন। আমি রাউজানের বাড়িতে বসেই একদিন মাইকিং শুনছিলাম, এক জনসভার। সেখানে বক্তার নাম ছিল, আবদুল্লাহ আল নোমান, ফাতেমা খাইরুন্নেসা লুসি। আমি ছোট মানুষ। মাইকের পিছে পিছে ঘুরছি, আর অবাক হচ্ছিলাম জনসভায় নারী বক্তার নাম শুনে। কিছুটা ভালোলাগা আর উত্তেজনাও যে কাজ করছিল তা বেশ মনে আছে। সেই যে ছোটবেলায় মাইকে নাম শোনা, বড় বড় নেতাদের নাম, উনাদের নাম শুনেই স্বপ্ন দেখেছিলাম, মাইকে কবে আমার নাম এভাবে বলবে! রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ না করলেও, সাংবাদিকতায় আসার পরে সেই স্বপ্নও পূরণ হয়ে যায়। মাইকে, ইথারে, বেতারে টিভিতে একাধিকবার আমার নাম ডাকা হয়েছে। যেই লুসি আপার নাম ছোটবেলায় শুনে চমকে উঠেছিলাম, সেই লুসি আপার সাথে বেতারে একাধিক প্রোগ্রাম করার সুযোগ হয়। আর নোমান মামা, যেহেতু আমার আত্মীয়, তাই উনার সান্নিধ্য পেয়েছি বরাবরই। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশের জনপ্রিয় ও অবিসংবাদিত নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমান ইন্তেকাল করেন ( ইন্নালিল্লাহিরাজিউন) তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুতে চট্টগ্রামে তো বটেই, সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাজনৈতিক অংগনে, একজন দক্ষ, দূরদর্শী এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে তার ভদ্র, মার্জিত ও বিনয়ী আচরণ বিরল এক দিক রাজনীতির জগতে। আদর্শগত অমিল থাকা সত্ত্বেও তিনি উনার দলের বিরোধী দলের কারো সাথে প্রতিহিংসাপরায়ন তো দূরের কথা! কখনো হেয় প্রতিপন্নও করেননি। প্রত্যেকের সাথে বিনয় এবং হাসিমুখে কথা বলা যেন তার স্বভাবজাত ছিল। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের অনুসারী হয়ে উনার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। জন্ম ও বেড়ে উঠাও রাজনৈতিক পরিবারে। পিতা অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলেন। মেজোভাই আবদুল্লাহ আল হারুণ বর্ষীয়ান ও দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিত। চট্টগ্রামের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত, উচ্চ শিক্ষিত এবং অভিজাত পরিবার হিসেবে এই পরিবারের জুড়ি মেলা ভার। এই ধরনের পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণেই, তার স্বভাব আর চিন্তা চেতনায়, সব সময় অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব বরাবরই আমরা লক্ষ্য করেছি। তিনি ভাসানী ন্যাপ থেকে ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান কর্তৃক গঠিত দল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটিকে সমুন্নত করার দিকেই মনোযোগী ছিলেন। তিনি সাংসদ ছিলেন, ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। বিশেষ করে যখন প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে অবহেলিত চট্টগ্রামকে উন্নয়নে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন। যেটি দেশ ও জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে। তিনি নগরীতে ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। রাজনীতির অবক্ষয়ের চরম দুঃসময়ে দেশে আবদুল্লাহ আল নোমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। হানাহানি, সংঘাত, সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য না করেও আদর্শগত বিরোধ সত্ত্বেও যে পারস্পরিক সহাবস্থানে থাকা যায়, তা আবদুল্লাহ আল নোমানের জীবন থেকেই সহজেই শিক্ষা নেয়া যায়। মানুষ নশ্বর। একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে সবাইকে যেতে হবে। চলে গেলেই বুঝতে পারি, তিনি কী ছিলেন, কেমন ছিলেন। আল্লাহ উনার আত্মাকে চির শান্তিতে রাখুক, সেটিই কামনা করি।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ যুগের কৃপাচার্য আমাদের হেডস্যার আহমেদ ছাবের
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা