বাংলাদেশের সকল আন্দোলন–সংগ্রামে আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে নজরুলের গান ও কবিতা। নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তাঁর রচনা আন্দোলনকে করেছে শাণিত। আন্দোলনের তোপের মুখে কোনো স্বৈরশাসক টিকে থাকতে পারেনি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল শত্রুদের ঘায়েল করতে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নজরুল ছিলেন অন্যতম প্রেরণাদাতা। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল নজরুলের সে বিখ্যাত গান -‘কারার ঐ লৌহ–কপাট/ ভেঙে ফেল, কররে লোপাট রক্ত–জমাট/ শিকল–পূজার পাষাণ–বেদী/ ওরে ও তরুণ ঈশান!/ বাজা তোর প্রলয়–বিষাণ ধ্বংস–নিশান/ উড়ুক প্রাচীর, প্রাচীর ভেদি/ গাজনের বাজনা বাজা!/ কে মালিক? কে সে রাজা/ কে দেয় সাজা/ মুক্ত–স্বাধীন সত্য কে রে/ হা হা হা পায় যে হাসি/ ভগবান পরবে ফাঁসি/ লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দী–শালায় আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।’ জহির রায়হান তাঁর কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেছেন, সেখানে সুরের ব্যঞ্জনা রক্তে আগুন খেলে যায়। ’৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি নির্মিত। মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে।
১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বাঙলার কথা’ নামে পত্রিকায় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি লেখেন। এই কবিতায় সুর দিলেন তিনি নিজেই। আর যখন দিলেন তখন তিনি ছিলেন বন্দি। এই কবিতা লেখার মাত্র তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই কবিতাটি প্রকাশ হয় ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে। এই বইটি প্রকাশের অল্পদিন পরেই তা নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, সংগঠক, নাট্যকার, সুরকারসহ নানা ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। সর্বোপরি তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতার কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি হিসেবেও আখ্যা দেয়া যায়। বাংলাসাহিত্যে তিনি ভোরের আকাশের তারার মতো, চিরন্তন ও ভাস্বর।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি–বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ড দেয়। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করেন, ইংরেজ সরকারের জেল–জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এর সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান।
যে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেছেন, সে আবেগেরই ভিন্নতর প্রকাশ–তাঁর গদ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের বিভিন্ন সমস্যা, যন্ত্রণা নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল। সেজন্য তৎকালীন রাষ্ট্র, সমাজ, জীবন, আশা–আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও নৈরাজ্যের ছবি বিধৃত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে। কাজী নজরুল ইসলাম গণমানুষের কবি। ১৯২১ সালে রচিত হয় তাঁর অসামান্য সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’। কবিতাটি এতোটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে বিশেষণটি নজরুলের নামের সাথে এখনও শোভাবর্ধন করে যাচ্ছে। বিদ্রোহী কবিতা কবি নজরুলের জীবন এবং কবি চেতনার এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি। এই কবিতায় তিনি লেখেন -‘মহা বিদ্রোহী রণ–ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন–রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রণিবে না/ বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত।’ প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ যেন নজরুলের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। এটিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে। অন্যায়ের প্রতিবাদ, কুসংস্কার ধ্বংস এবং নতুন সৃষ্টি এই ত্রিমাত্রিক সত্তাই নজরুল প্রতিভাকে নিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি বলেন -‘আমি দুর্বার/ আমি ভেঙে করি সব চুরমার/ আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল/ আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!’
নজরুলের কাব্যগ্রন্থ‘অগ্নিবীণা’য় রয়েছে –রণ–ভেরী, কামাল পাশা, বিদ্রোহী, প্রলয়োল্লাস, ধূমকেতুর মতো কবিতাগুলো। নজরুল নবযুগ ও ধূমকেতু সংবাদপত্রে জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য অনেক প্রবন্ধ, কবিতা লিখেছেন। যা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী নবযুগের সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনচেতা নজরুল আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন যুগে যুগে।