দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য দূর করতে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, এ চুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে, যা কোনো দেশের জন্যই ভালো হচ্ছে না। ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস তিস্তা চুক্তি নিয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। ইউনূস ঢাকায় তার সরকারি বাসভবনে বসে পিটিআইকে এই সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে শুক্রবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। দুই দেশের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মত ভাটির দেশগুলো কতটা পানি পাবে, তার সুনির্দিষ্ট অধিকার তাদের আন্তর্জাতিক আইনে দেওয়া আছে, যা সমুন্নত রাখা প্রয়োজন। পানি বণ্টনের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার ফলে কোনো লাভ হচ্ছে না। আমি যদি জানি আমি কতটুকু পানি পাব, তাহলে সেটি আমার জন্য ভালো হবে। এমনকি পানির পরিমাণ নিয়ে আমি যদি সন্তুষ্ট নাও হই, তারপরও সেটা জানা আমার দরকার। এই সমস্যার সমাধান হতে হবে। বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকার দ্রুত তিস্তা চুক্তি করার জন্য ভারতকে চাপ দেবে কিনা, সেই প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, ‘চাপ’ একটি বড় শব্দ। আমি এটা বলছি না। তবে আমরা চাইব। আমাদের একসঙ্গে বসে সমাধান করতে হবে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে দুইপক্ষ একমত হয়েছিল। মনমোহন সিংয়ের সফরেই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়। মমতার ভাষ্য হল তার রাজ্যেই পানির সংকট রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও মমতার মত বদলায়নি। ফলে দুই দেশের মধ্যে গত এক যুগে অধিকাংশ বৈঠকেই তিস্তার প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। চলতি বছরে দিল্লি সফরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিরেন, তার সরকার ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতের একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন নতুন কোনো বিষয় নয়, খুবই পুরনো বিষয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। এই আলোচনা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমল থেকে। আমরা সবাই চেয়েছিলাম চুক্তিটি চূড়ান্ত রূপ পাক। এমনকি ভারত সরকারও প্রস্তুত ছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এর জন্য তৈরি ছিল না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত ভাটির দেশগুলোর নির্দিষ্ট অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে তিস্তা চুক্তির সমাধান করার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন অন্তর্র্বতী সরকার প্রধান।
কয়েকদিন আগে পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকারের পানিসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ফের শুরু করার জন্য চাপ দেবে ঢাকা।
উজান ও ভাটির দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে (অভিন্ন নদীর) দুই দেশকেই আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুসরণ করার ওপর জোর দেন রিজওয়ানা। উপদেষ্টার তিস্তা বিষয়ে মন্তব্যের কয়েকদিন পরপরই মুহাম্মদ ইউনূস তিস্তা নিয়ে তার সরকারের মনোভাব তুলে ধরলেন।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে ঢাকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নিয়ে পিটিআইকে ইউনূস বলেন, চুক্তি সইয়ের আগে এ ধরনের একটি সংকট মোকাবিলায় একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ভারতীয় হাই কমিশনার যখন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন, আমি বলেছি, বন্যার সময় পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা আরেকটু ভালো ব্যবস্থাপনার ওপর কাজ করতে পারি এবং এই ধরনের দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট সমস্যারও সমাধান পারি। দুই দেশের মধ্যে এমন সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমস্যা সমাধানে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। কারণ তাতে করে গণমানুষের দুর্দশা লাঘব হবে। এ ধরনের মানবিক পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থেই সহায়তা করবে।
সীমান্ত হত্যার নিন্দা জানিয়ে ইউনূস বলেন, কাউকে হত্যা করা কোনো সমাধান বয়ে আনে না। কারণ এই সমস্যা মোকাবিলার আইনি উপায় হাতে রয়েছে। এটা (সীমান্ত হত্যা) একতরফা ব্যাপার। আপনার দেশ দখলের জন্য কেউ সীমান্ত অতিক্রম করছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে।