আনন্দলোকে মঙ্গোলালোকে

ছেলে-শিশু ও মেয়ে-শিশুর মধ্যে সমতা সৃষ্টির জন্য কাজ করতে হবে

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

আজ যে শিশু, আগামীকাল সে দেশের উজ্জ্বল কাণ্ডারি। তাকে বলা হয় ‘পৃথিবীর সোনালি আশা’। তাকে নিয়ে এই পৃথিবীতে রচিত হয়েছে হাজার হাজার কবিতা। হাজার হাজার গান। নির্মিত হয়েছে নাটক, সিনেমা। তার ভেতরে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত সম্ভাবনার কথা। আমাদের দেশে শিশুর ভবিষ্যত নিয়ে বলতে গেলেই একটি কবিতার লাইন উঁকি দিয়ে যায় মনের কোণে। সেটি হলো : ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’

আমরা সব সময় বলি, শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। সে আজ শিশু। ছোটো। আগামীতে সে বড় হবে। হবে বড় বৃক্ষের মতো। তার উদ্দীপ্ত ও সৃষ্টিশীল চিন্তার মাধ্যমে আগামী দিনের বিশ্বকে সে রাঙিয়ে তুলবে। আজকের চেয়েও আরও সুন্দর, সংঘাতহীন ও উন্নত করে তুলবে পৃথিবীকে। তাই শিশুকে সেভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ দিতে হবে অভিভাবকদের। শিশু অধিকার রক্ষায় সমাজে সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে একত্রিত করতে হবে। জাতীয় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সকল পর্যায়ে সব ভেদাভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে শিশুর জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে।

শিশুরা ছোটো হলে কী হবে, তাদের নিয়ে ভাবনায় অস্থির বড়রা। এ জন্য পৃথিবীতে স্লোগান তৈরি হয়েছে ‘সবার আগে শিশু’। যাঁরা সমাজের অভিভাবক, তাঁদের অনেক দায়িত্ব। তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে বলছেন ‘শিশুরা আগামী দিনের আলো।’

সামাজিক জীবনে শিশুরা এখনো অবহেলিত। এই শিশুদের মাঝেও আছে বড় বৈষম্য। বৈষম্য ছেলেশিশু আর মেয়েশিশুকে ঘিরে। সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা, বেড়ে ওঠার নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রে এরা বৈষম্যের শিকার, প্রতিনিয়ত। মেয়ে শিশু বিষয়ে হুমায়ুন আজাদ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ওর অনেক শত্রু। কোনো সমাজ ওর চোখ অন্ধ করে দিতে চায়। কোনো সমাজ ওর পা খোঁড়া করে দিতে চায়। কোনো সমাজ ওর কান বধির করে দিতে চায়। আরবে অনেক আগে মেয়েদের জীবিত কবর দেয়া হতো। একটি মেয়ে যেই জন্ম নিতো, সারা বাড়িতে শোকের ছায়া নামতো। এখনো আমাদের দেশে অনেক বাড়িতে মেয়ে জন্ম নিলে সবাই দুঃখ পায়। চীনে একসময় মেয়েদের শিশু বয়স থেকেই পরিয়ে রাখা হতো কাঠের জুতো। ওরা হাঁটতে পারতো না। কোনো কোনো দেশে ছেলেরা বিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতো, বিধাতা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে মেয়ে করোনি বলে। মেয়ে হওয়ার থেকে পশু হওয়াও ভালো। আর মেয়েরা বিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতো, বিধাতা তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে তুমি যা করেছ, তার জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ।

শিশুকাল থেকে মেয়েরা পীড়নের শিকার। ও মেয়ে বলে ওকে বঞ্চিত করা হয় ভালো খাবার থেকে, ভালো পোশাক থেকে। ও মেয়ে, তাই ওকে সব সহ্য করতে হয়। ও শারীরিকভাবে দুর্বল। তাই তার প্রতিবাদ চলে না। শরীরই যেন ওর নিয়তি। ও ভয় পায়, ওকে ভয় দেখায়। হাজার বছর ধরে চলছে ওর ওপর অত্যাচার। এতো বঞ্চনা, এতো লাঞ্ছনা সত্ত্বেও ও এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। পৃথিবীতে চিরকাল ধরে চলছে শোষণ। শক্তিমান শোষণ করে দুর্বলকে, ধনী শোষণ করে গরিবকে, আর সবাই শোষণ করে ওকে। ও মেয়ে। পৃথিবীতে ও সবচেয়ে শোষিত। পৃথিবীতে বহু মানুষের স্বাধীনতা নেই। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতাহীন হচ্ছে ও। কারণ ও মেয়ে।

এখন সেই মেয়ের অধিকার এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের অর্থাৎ অভিভাবকদের। মেয়েরা পৃথিবীর অর্ধেক, সভ্যতার অর্ধেক। সভ্যতার অর্ধেক মেয়েদের সৃষ্টি। ভবিষ্যৎ সভ্যতার বড়ো অংশ সৃষ্টি হবে তাদের প্রতিভায়। এতো দিন মানুষ কাজে লাগিয়েছে তার অর্ধেক প্রতিভা, অর্থাৎ ছেলেদের প্রতিভা। ভবিষ্যতে মেয়ে আর ছেলের মিলিত প্রতিভায় বিকশিত হবে মানুষ। পৃথিবী হয়ে উঠবে আরো সুন্দর, আরো কল্যাণময়।

ছেলে ও মেয়ের মধ্যে এই যে বৈষম্য সমাজে লক্ষ্য করা যায়, তা দূর করতে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে মা ও বাবাকে। এর পর পরিবারের অন্য অগ্রজ কাউকে। শিশুকাল থেকেই যদি ছেলে শিশু ও কন্যা শিশুর মধ্যে ব্যবধান দূর করা যায়, যদি তাদের বোঝানো যায় যে তারা সবাই একই পরিবেশে একই মাত্রায় বেড়ে উঠবে, তাহলে এর ফল গ্রহণ করবে সমাজ। সৌভ্রাতৃত্ব, সহধর্মিতা, সহমর্মিতা ও বোঝাপড়ার অগ্রগতি সাধনের মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে মাবাবাকে।

আমরা প্রত্যক্ষ করি, সামাজিককরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মেয়েশিশু ও ছেলেশিশুর মনে নারী ও পুরুষের বোধ তৈরি করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বৈষম্য ও মানসিকতা দূর করা যাবে না তাড়াতাড়ি। তারজন্য প্রয়োজন হবে মনোগত উন্নয়ন। এই মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে একমাত্র অভিভাবকরাই। পড়াশোনায়, খাবারে দাবারে, আচার ব্যবহারে তারা ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর মধ্যে সমতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সমতার উন্নয়নের মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে সম্পর্ক। সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে পারে উদার মনোভাব। এই মনোভাব তৈরিতেও প্রভাব বিস্তার করতে পারেন অভিভাবকরা।

বিশ্বের এক জননন্দিত মহানায়কদক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘যে জাতি শিশুদের কথা ভাবে না, সেটা কোনো জাতিই নয়।’ তাই বলা যায়, একটি জাতিকে যদি অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই দরকার শিশুর পরিচর্যা। মেধায় মননে শক্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে। [লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত স্কেচটি শিল্পী উত্তম সেনের আঁকা]

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো,

বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্লিন সিটি গড়তে জাইকার সহযোগিতা চাইলেন মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধ২১ অক্টোবর গারাংগিয়া দরবারের ত্বরিক্বত সম্মেলন