সুন্দরের জয়যাত্রা সবখানে
কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধার একটা লেখা পড়েছিলাম। তিনি বলছিলেন, কিছুদিন আগেও হাতে লিখতেন দেশের সমস্ত লেখক। এই লেখকদের হাতের লেখারও রয়েছে হরেক রকমফের। আর সেই সব হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতে ধরা পড়েছে অনেকের ব্যক্তিত্বও। নাসির আলী মামুন এক সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছেন, আপনি হাতে লেখেন, না কম্পিউটারে? হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, মাঝখানে একসময়ে কম্পিউটারে লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু কিছুদিন পরে বাদ দিয়েছেন। তিনি খেয়াল করেছেন, নিজের কাছে লেখার কোনো নমুনা থাকছে না। সঙ্গে একটু ব্যাখ্যাও দিলেন, চিন্তার যে অগ্রগামিতা অথবা কাটাকুটি অথবা লেখার ধারাবাহিকতা এর কোনো কিছুই কম্পিউটারে লিখলে সামনে আর থাকে না। তাই আবার হাতের লেখায় ফিরে এসেছেন। এরপরে যোগ করেছেন নিজস্ব উপলব্ধি, তাঁর কাছে যেকোনো লেখায় ধারাবাহিকতার ওই নমুনা থাকাটা জরুরি।
হুমায়ূন আহমেদের ওই জবাবে, একটি বিষয় বেশ বোঝা যায়, হাতে লিখে এগিয়ে যাওয়া কাহিনির ক্ষেত্রে এর সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, সম্মার্জন–এই ধরনের বিবিধ কাটাকুটিতে লেখক ওই রচনার নিজস্ব উত্তরণের এক ব্যক্তিক সাক্ষ্য রেখে যান। টাইপরাইটারে লেখার ক্ষেত্রে সে সাক্ষ্য খানিক অথবা বেশ কিছুটা থাকলেও কম্পিউটারের সফট বা নরম অক্ষর লিপিকার পৃষ্ঠায় কোনো সংশোধনমাত্র তা উধাও হয়ে যায়।
তবু বাংলাদেশের লেখকদের ভেতরে প্রথম যিনি যন্ত্রেই ‘লেখা করতেন’, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। মুনীর চৌধুরী তাঁর অক্ষরবিন্যাস করা জর্মান অপটিমা–মুনীর টাইপরাইটারের একটি সৈয়দ হককে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার আগে, এরপর থেকে তিনি ওই যন্ত্রে গল্প–উপন্যাস লিখতেন, পরে কম্পিউটারে; কবিতা লিখতেন কলমে।
২.
এখন ডিজিটাল যুগে প্রায় সবাই লিখছেন কম্পিউটারে। ডিজিটাল যুগে এসে হাতের লেখা গুরুত্ব হারিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু আমি নিজে কম্পিউটারে লিখলেও হাতের লেখার সৌন্দর্য আমাকে আকর্ষণ করে বেশি। মানুষ মাত্রই সুন্দরের পূজারী, সৌন্দর্যের উপাসক। বলা হয়ে থাকে, সুন্দর মুখের জয়যাত্রা সবখানে। সৌন্দর্যের একটা আকর্ষণ সবার কাছেই আছে। সুন্দর অবয়ব, রুচি, ব্যবহার– সবমিলিয়ে তৈরি হয় ব্যক্তিত্ব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা লক্ষ করি, সুন্দর ছবি বা দৃশ্য চোখে পড়লেই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। মনের অগোচরে লাইক পড়ে যায় সেখানে। কথিত আছে, সম্রাট শাহ্জাহান তাঁর প্রিয়তমা পত্নী মমতাজকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে সৌন্দর্যের প্রতীক পৃথিবীর অন্যতম আর্শ্চয ‘তাজমহল’ নির্মাণ করেছিলেন। সে–হিসেবে বলা যায়, সুন্দর হাতের লেখার প্রশংসাও সর্বত্র। এতে কোনো সন্দেহ নেই। খারাপ হাতের লেখার প্রতি কমবেশি সবার থাকে বিরক্তি। তাই হাতের লেখা খারাপ হলে নিজেরই এক রকম সংকোচবোধ থাকে। তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও থাকে অনেকের।
হাতের লেখা খারাপ হলে পরীক্ষক খাতা পড়তে চান না। পরীক্ষকগণ নির্দিষ্ট সংখ্যক খাতা দৈনিক মূল্যায়ন করে থাকেন। তাই সহজে পড়তে না পারলে বিরক্ত হয়ে তীর্যক রেখা টেনে কম বা গড় নম্বর দিয়ে রাখেন বলে শোনা যায়। হয়ত বিষয়বস্তুটা ঠিকঠাকই লেখা হয়েছে, অথচ অসুন্দর হাতের লেখার জন্যে ছাত্ররা নম্বর হারাচ্ছে। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করতে পারি। ২০১৬ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ছাত্র শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কথা শুনতে শুনতে নোট লিখে, তারা পরে সেগুলো অনেক ভালো মনে রাখতে পারে এবং তাদের ধারণা অনেক পরিচ্ছন্ন থাকে। কম্পিউটার বা ট্যাবে যারা নোট নেয়, তারা অনেক লিখতে পারলেও পরে মনে রাখতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের জন্য হাতের লেখার গুরুত্ব অনেক। হাতে একটি চিঠি লেখা, আঙুলের জটিল ব্যবহার, এগুলোর জন্য শিশুদের অনেক অনুশীলন করতে হয় এবং তার ভেতর দিয়েই শিশুদের জ্ঞান লাভ হয়। নর্থ ক্যারোলিনা গ্রিনসবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গবেষণার সহ–লেখক রবার্ট উইলি বলেছেন, আমরা মনে করি, আমাদের ফলাফলগুলো আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কীভাবে হস্তাক্ষর বিভিন্নভাবে সুবিধাজনক। তিনি ব্যাখ্যা করেন, একটি নতুন শব্দ শেখার অর্থ হলো তা মানুষের মনে একটি প্রতীককে বিমূর্তভাবে ফুটিয়ে তোলা। মানব শরীরে দৃশ্য, শ্রবণ এমন অঙ্গগুলোকে সংযুক্ত করে। হাতের লেখা টাইপিংয়ের তুলনায় এভাবে বিভিন্ন মাত্রায় সংযোগকে সক্রিয় করতে পারে।
চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড দেখা যায়, ‘শরীফা আর্ট স্কুল, সুন্দর লেখা শেখার স্কুল’ নামক এক প্রতিষ্ঠানের। নগরে তার অনেকগুলো শাখা আছে। কয়েকদিন আগে নাসিরাবাদের একটি শাখায় আমি প্রত্যক্ষ করেছি হস্তাক্ষর কীভাবে সুন্দর করা যায়–তার দক্ষ প্রশিক্ষণযজ্ঞ। স্কুলের পরিচালক শিল্পী মোঃ আমিরুল হক নিজেই হাতে ধরে শিশুদের চিত্রাংকন ও সুন্দর হস্তাক্ষরের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। যতদূর জানা যায়, শরীফা আর্ট স্কুল ও শরীফা সুন্দর লেখা শেখার স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৫ সালে। চট্টগ্রামের ডি সি রোড চকবাজার শাখার মাধ্যমে এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুনাম অর্জন করেছে এই স্কুলটি।
শিল্পী মোঃ আমিরুল হকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আর্ট স্কুল ও সুন্দর হাতের লেখা শিখতে আসে শিশু থেকে শুরু করে তরুণরাও। এমনকি কলেজের অধ্যাপকও এখানে শিক্ষার্থী। বিশেষ করে শিশুদের তিনি তৈরি করছেন পরম আদর ও স্নেহে। শিশুদের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে এ কাজে প্রাণিত করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ২০৫ তরুণকে নিয়ে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থী একটি কিবোর্ডে কি টেপানোর পরিবর্তে যদি একটি লেখার জন্য কাগজ–কলম ব্যবহার করে একটি পাঠ্য তৈরি করে, তাহলে সে সময় আরও বেশি মনোসংযোগ করতে পারে, স্থির থাকে এবং আরও ভালো স্মৃতিশক্তি অর্জন করে, যা তার স্পর্শের অনুভূতিকে জাগ্রত রাখে। তথ্য শোষণের জন্য হাতে লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মস্তিষ্ক এবং সৃজনশীলতা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক লিসা আজিজ–জাদেহ বলেছেন, ইন্দ্রিয়গুলোকে সক্রিয় রাখতে পারলে আরও ভালো শিক্ষার্থী হয়ে ওঠা সম্ভব। কাগজ ও কলমের স্পর্শ দিয়ে লেখা মস্তিষ্কের অঞ্চলকে সক্রিয় রাখে, যা শেখার এবং মুখস্থ করার সঙ্গে জড়িত।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ভ্যান ডের মির শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদেরও কলম এবং কাগজ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেছেন, হাতের লেখার অনুশীলন রাখা মস্তিষ্কের জন্য একটি খুব ভালো ব্যায়াম। এটি একটি ব্যস্ত রাস্তায় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার সমতুল্য। তাই আমরা মনে করি, কম্পিউটার ব্যবহার করলেও হাতের লেখার সঙ্গেও আমাদের থাকা উচিত, কারণ এটি বিকাশমান মস্তিষ্কের জন্য খুব ভালো। গবেষকরা এটাও বলেছেন, হাতে লেখার দক্ষতা ধরে রাখতে হবে, সেটা নষ্ট হলে শিশুদের জ্ঞানার্জনও বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। আবার প্রাপ্তবয়স্করা আগে–ভাগেই বুড়ো হয়ে যাবেন। তাই কাগজে–কলমে লেখা চালিয়ে যেতে হবে। নিজের জীবনের কিছু কথা কাগজে–কলমে লেখা হোক, এতে ক্ষতি নেই। উপরন্তু নিজেকে নিজে তালাশ করা যাবে। মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বাড়বে, স্মৃতিশক্তি অটুট থাকবে। শুধু মস্তিষ্ক নয় শরীরের হাত ও অন্য অংশের পেশি মজবুত থাকবে। অন্তত তাদেরও কিছু ব্যায়াম হবে।
শরীফা আর্ট স্কুল ও শরীফা সুন্দর লেখা শেখার স্কুল শিশুদের পরিচর্যা করছে সনিষ্ঠ আন্তরিকতায়। ডিজিটাল যুগে শিশুদের স্বভাব যেখানে বদলে যাচ্ছে, সেখানে এই স্কুল মানসগঠনে সহায়তা করছে তাদের।
আমরা অনেকেই জানি না ‘হাতের লেখা দিবস’ নামে একটি দিবস উদযাপিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে প্রতিবছর ২৩ জানুয়ারি জাতীয় হাতের লেখা দিবস পালিত হয়। রাইটিং ইনস্ট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউআইএমএ) দিবসটি পালনের উদ্যোক্তা। জানা যায়, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তির সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন জন হ্যানকক। খুবই চমৎকার ছিল তাঁর দীর্ঘ স্বাক্ষর। সে কারণেও হ্যানককের স্বাক্ষর খুব বিখ্যাত। তাঁর জন্মদিন ২৩ জানুয়ারিকেই লেখা দিবস হিসেবে উদ্যোক্তারা বেছে নিয়েছিলেন। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে হাতের লেখার গুরুত্ব তুলে ধরা এবং লিখতে আগ্রহী করে তোলা। আমরা এ দিবস পালনের কথা বলছি না। বলছি সুন্দর হাতের লেখার গুরুত্বের কথা। এই তো সেদিন লেখক জিএম জহির উদ্দীন আমাকে তাঁর লেখা একটি বই ‘বিধ্বস্ত প্রেম বিপন্ন ভালোবাসা’ উপহার দিয়েছিলেন। অটোগ্রাফে যে–কথাগুলো তিনি লিখলেন, সেগুলো খুবই সুন্দর। তারচেয়ে বেশি সুন্দর তাঁর হাতের লেখা। আমাদের প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও প্রয়াত বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধরের হাতের লেখাও ছিল অপূর্ব। এরকম উৎপলকান্তি বড়ুয়া, শাহানারা ঝরনাসহ অনেক লেখকের হাতের লেখা আমাকে মুগ্ধ করে, তাদের সবাইকে স্মরণ করছি এ লেখায়।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।