দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখলাম, খ্যাতিমান অভিনেতা আবুল হায়াত লেখা শেষ করেছেন নিজের আত্মজীবনী গ্রন্থ। নাম দিয়েছেন ‘রবি পথ’। চলছে প্রচ্ছদ অলংকরণ। সেটির দায়িত্ব নিয়েছেন অভিনেতার মেয়ে সুঅভিনেত্রী ও চিত্রকর বিপাশা হায়াত। ৩শ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ করবে সুবর্ণ প্রকাশনী। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা আমরা পড়ে থাকি। ভালো লাগে। আমরা জানি, আবুল হায়াতের ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছিল চট্টগ্রামে। একসময়ে এই চট্টগ্রামে তাঁর দিন ভালোই কেটেছে। তাঁর লেখা থেকে পাই, তাঁর বাবা মরহুম মোহাম্মদ আব্দুস সালাম রেলওয়েতে চাকরি করতেন ব্রিটিশ আমল থেকে। চট্টগ্রামের সিআরবিতে তাঁর দপ্তর ছিল সেই পঞ্চাশ–ষাটের দশকে। রেলওয়ে কর্মচারীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র ‘ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের’ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। দীর্ঘকাল। আমৃত্যু। সেখানেই এক অনুষ্ঠানে একবার তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল জন্মদিন উপলক্ষ্যে। শান্তশিষ্ট এই মানুষটা প্রচুর বই পড়তেন। অনুষ্ঠান শেষে অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন সে–দিন। আবুল হায়াত লিখলেন, ‘জানালায় দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষায় ছিলাম তার। দরজা খুলে বেরুলাম বাগানে। প্রধান রাস্তার ওপরেই বাসা ছিল আমাদের, টাইগার পাসে। হঠাৎ শুনি রিকশাওয়ালার সাথে বেশ একটা তর্কাতর্কি লেগে গেছে আব্বার। আমার আব্বার মত ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি আজ অবধি। সেই মানুষটা হঠাৎ কেন এমন ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন, বুঝলাম না।
-‘আমি ছ’আনার বেশি এক পয়সাও দেবো না’। আব্বা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলছেন, শুনলাম।
‘আট আনার কমে আমি নেবো না।’– রিকশাচালকের জবাব। চাটগাঁর ভাষায়।
‘তোমাকে কিন্তু ছ’আনা বলে এনেছি।’
‘আমি আপনাকে বলেছি আট আনার কম নেবো না। আট আনাই দিতে হবে।’
‘না দিলে কী করবে? মারবে?’
‘দরকার হলে তাই করবো।’
রিকশাচালক তখন উত্তেজনার চরমে। বেচারা সারা দিনের পরিশ্রমের ফলে মেজাজ হারিয়েছে। আর আব্বাও সারা দিন অফিস করে, সন্ধ্যায় ক্লাবে অনুষ্ঠান শেষে বেশ ক্লান্ত। তার চেয়ে আব্বার ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হলো না– তার কাছে রিকশাচালকের দাবিটা অনৈতিক মনে হয়েছে।
–আব্বা, দিয়ে দেন না আট আনা। –আমি বলেছিলাম।
‘না, কেন দেবো? আমি তো ভাড়া বলে এনেছি। আমাকে মারবে বলেছে, মেরে নিয়ে যাক পয়সা’।
এরপর রিকশাচালকের দিকে ফিরে বলেন–
‘কই এসো, মারো আমাকে। ছুরি নাই? ছুরি বের করো। না থাকলে, এই যে আমার সিনা, মেপে নিয়ে যাও– সেই মাপের ছুরি নিয়ে এসে মেরে পয়সা নিয়ে যাও’।
উরে বাপরে! এত উত্তেজিত আব্বা! ভাবাই যায় না। প্রশান্ত মহাসাগরের মতো শান্ত যে মানুষ, তার ভেতর এত রাগ আমি কল্পনাই করতে পারছিলাম না। এর মধ্যে আম্মা এবং আমার ছোট দু’ বোন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। উদ্বিগ্ন সবাই।
–আব্বা, আসেন, বাসায় আসেন, আমি পয়সা এনে দিচ্ছি।
‘না, এক পয়সাও বেশি দেবো না।’
‘নিবো না আপনার পয়সা’– বলেই এক হেঁচকা টান দিয়ে রিকশায় উঠে চলে গেল রিকশাচালক।
এভাবেই বর্ণনা পেলাম আবুল হায়াতের। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, আরো বাকি আছে।
বাবাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন তাঁরা। বাবা তখনও ফুঁসছেন রাগে। মা, বাবার উপর বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলছিলেন তাতে বা্বার রাগ আরও বেড়ে গিয়েছিল। হাতের ফুলের তোড়াটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে প্রায় চিৎকার দিলেন।
‘চুপ করো। বেয়াদ্দব একটা রিকশাওয়ালা, আবার তার পক্ষে কথা বলো তোমরা!’
বেশ একটা উষ্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে সব ঠাণ্ডা হয়ে এলো। বাবাও স্বীকার করলেন রেগে যাওয়াটা মোটেও উচিত হয়নি তাঁর। ওটা নিশ্চয় এনায়েত বাজারের রিকশাওয়ালা, ক্লাবের আশপাশেই থাকে হয়তো। দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে তার ভাড়াটা দিয়ে দেবেন তিনি।
তারপরই ঘটল, আরেক ঘটনা। বাবা হঠাৎ আঁৎকে উঠলেন।
‘এই যা!’
‘কী হলো?’
মাও আতঙ্কিত।
‘আমার প্যাকেটটাতো নামানো হয়নি রিকশা থেকে’।
‘কিসের প্যাকেট’?
‘আরে, নতুন দুটো প্যান্ট আর শার্ট বানিয়েছিলাম– দর্জি ক্লাবে পৌঁছে দিয়ে গেল সন্ধ্যায়’।
‘এনেছিলেন আপনি? যা ভুলো মন আপনার।’ মা বলেছিলেন।
‘আরে না। সারা পথ কোলের ওপর ধরে রেখেছিলাম। তারপরই তো লেগে গেল ঝামেলা।’
‘হায় হায়। এতগুলো টাকার জিনিস।’
আবুল হায়াত বললেন, ‘রিকশায় থাকলে নিশ্চয় দিয়ে যেত রিকশাচালক।’
‘হুু যার নীতির ঠিক নেই সে আবার…’ বলেই আচ্ছা— সামলে নিলেন নিজেকে বাবা। বললেন, ‘ও আর পাওয়া যাবে না। জন্মদিনটাই অপয়া।’
মন খারাপ করা মানুষগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ভুলে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। চারদিকে নিস্তব্ধতা। তার মধ্যেই বাইরের জাফরিতে প্রবল ধাক্কা। কে যেন বাইরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে গভীর রাতে। কী হলো! কী হলো!
উঠে গিয়ে দেখেন বাবার কাপড়ের প্যাকেট হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে সেই রিকশাচালক। বাবাও ততক্ষণে উঠে এসেছেন।
‘এই নেন আপনার কাপড়। রিকশাতে ফেলে এসেছিলেন।’
সবাই হতবাক।
মানুষটির সততা তাঁদের যতটা মুগ্ধ করেছে। তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছিল তার সম্বন্ধে নেতিবাচক স্মরণ করায়।
বাবা তাকে সিনাতে টেনে নিলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন তার মেজাজ হারানোর কারণে। পাঁচ টাকা বকশিশ দিতে চাইলেন। কিছুতেই রাজি হলো না। রিকশাচালক ভাড়াটা নিয়ে সালাম দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিল।
প্রিয় পাঠক, এই ঘটনা থেকে আমরা কী শিখলাম? আবুল হায়াত বলেন, শিখলাম-‘মানুষের ওপর কখনো বিশ্বাস হারাতে নেই’। এই বিশ্বাস রাখতে গিয়ে হয়তো আমরা ঠকেছি, হয়তো আগামীতেও ঠকবো। কিন্তু এই বিশ্বাস থেকে অর্জন করা যায় মানুষের ভালোবাসা।
কিছুদিন আগে গত ১ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা গিয়েছিলাম তরুণদের এক সম্মেলনে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় তরুণ লেখক সম্মেলনের’ উদ্বোধনী দিবসে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। তিনি তরুণদের এই কথাটিই বলেছিলেন তাঁর বক্তব্যে। বলেছিলেন, ‘তরুণরাই যুগে যুগে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মূলধন হলো বিশ্বাস।’ প্রধান আলোচক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বললেন স্বপ্নের কথা। আমি বলেছিলাম অনুপ্রেরণার কথা।
অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে একজন বন্ধু। একজন বন্ধু সৃষ্টিশীল সকল কাজের নিরন্তর প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। একজন প্রিয়জনের জন্য মানুষ যুদ্ধ করে, সমুদ্র পাড়ি দেয়, কবি হয়, মাতাল হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘যে প্রেমিকার রুচি যত উন্নত, তার প্রেমিক সেই রুচির সমকক্ষ হতে চেষ্টা করবেই। প্রথম যে কিশোরীর সঙ্গে আমার প্রণয় হয়, সে কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতো, একেবারে কবিতা পাগল ছিলো যাকে বলে। তাকে খুশি করার জন্যই আমি বেপরোয়া হয়ে কবিতা রচনার চেষ্টা করি, তার আগে কবি বা লেখক হবার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমার। পৃথিবীর প্রায় সব সৃষ্টিশীল কাজে প্রেমই প্রেরণা’। পাবলো নেরুদা তাঁর লেখালেখির সমস্ত সাফল্যের পেছনে তাঁর প্রিয়জন ম্যাটিলডের ভূমিকা অনন্য বলে উল্লেখ করেছেন। ম্যাটিলডে হচ্ছেন নেরুদার স্ত্রী। নেরুদা বলেন, ‘আমার সমস্ত অনুভূতিই ছিলো শুধু ওর জন্য, তা প্রকাশ করেছি একশোটা প্রেমের কবিতা নামক কাব্যগ্রন্থে। মৃত্তিকা আর জীবন আমাদের নিবিড় করে তুলেছিলো–ও ছিলো আমার অমূল্য সম্পদ। অনেকেরই হয়তো শুনতে ভালো লাগবে না যে, আমার দু’জনই ছিলাম খুব সুখী। … আমার সবকিছুই তারই জন্য। যদিও জানি আমার সবকিছুই অতি সামান্য, সামান্য সে দান’।
আমরা সুন্দর মনের সৃষ্টিশীল বন্ধু চাই, চাই প্রিয়জন। তার নির্মল হাসি চাই– যে হাসির উচ্ছল ছন্দে ঝরে পড়বে টুকরো টুকরো মুক্তো, থরে থরে ফুটে উঠবে বর্ণিল পুষ্প, ফল হবে, পাতা হবে, শস্য হবে। নানা মতের বন্ধুরা হাঁটবে অভিন্ন পথে। সবাই ভালো থাকলে–সবকিছু ভালো; আর কারো মুখমণ্ডলে মেঘ জমলে যেন সব অন্ধকার। তবে আমাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। এই সম্পৃক্ততা হোক নতুন কাজের। কাজের ভেতরেই তো আনন্দ। যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম, একজন মানুষের এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা। বিশ্বাস ও ভালোবাসাই আমাদের বড় সম্পদ। তার ওপর ভরসা করেই প্রত্যাশা করি সমৃদ্ধ আগামী।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।