আজ ৮ সেপ্টেম্বর। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো এদিনটিকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিনটি। দেশের সমৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে সাক্ষরতা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা বলতে আমরা অনুধাবন করি অক্ষর পরিচিতি, লেখা ও পড়ার সক্ষমতা। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এর পরিধি। এখন শুধু স্বাক্ষর জ্ঞান থাকলেই সাক্ষরতা বলা চলে না। গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসরে সক্ষরতা শব্দের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ১৯০১ সালে লোক গণনার অফিসিয়াল ডকুমেন্টে। শুরুতে স্ব অক্ষরের সঙ্গে অর্থাৎ নিজের নাম লিখতে যে কয়টি বর্ণমালা প্রয়োজন তা জানলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। ১৯৪০–এর দিকে পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হতো। ষাটের দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হিসাব–নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সাক্ষর মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতো। আশির দশকে লেখাপড়া ও হিসাব–নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃত হয়। বর্তমানে এ সাক্ষরতার সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতা, প্রতিরক্ষায় দক্ষতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতাও সংযোজিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে তাই শুধু শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাই যথেষ্ট নয়, জনসংখ্যাকে যথার্থ অর্থেই সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা, সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত ২০৩০ সালের মধ্যে সহগ্রাব্দ উন্নয়ন (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের তালিকায় উন্নীত হওয়ার কাজটি সহজতর হবে নিঃসন্দেহে। তাই বিশ্বদরবারে স্বাধীন দেশের মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে নিজেদের গৌরব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত সাক্ষরতা অভিযানে সবার অংশগ্রহণ আবশ্যক।
দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগ সর্বোচ্চ ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ হার নিয়ে এগিয়ে। অন্যদিকে সর্বনিম্ন সাক্ষরতার হার ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। সমপ্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে সাক্ষরতার হারের হিসাবে বলা হয়, দেশের নারী–পুরুষ মিলে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যার মধ্যে অঞ্চলভেদে গ্রামাঞ্চলে ৭১ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
অন্যদিকে নারী–পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের সাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১১ সালে নারী–পুরুষ মিলে সাক্ষরতার হার ছিলো ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রত্যাশিত আয়ু সবচেয়ে কম ছিল বাংলাদেশে ৫৮ বছর, এখন প্রায় ৭৪ বছর। আর সে সময় পাকিস্তানে ছিল সবচেয়ে বেশি ৬০ বছর, এখন ৬৭ বছর; ভারত ৫৭ থেকে ৭০–এ তুলতে পেরেছে। অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন বাঁচে এখন। অন্যদিকে মোট এবং নারী বয়স্ক সাক্ষরতায় ভারতের পেছনে থেকেও এখন ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যেমন করে মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে অন্তর্ভুক্তিতে। তবে মাধ্যমিকে মধ্যখানে পা পিছলালেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। গেল তিন দশকে চিত্তাকর্ষক চিত্র দারিদ্র্য হ্রাসের বেলায়–চরম দারিদ্র্য প্রকোপ ভারতের চেয়ে কম এ বাংলাদেশে। স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যি যে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কম কৃতিত্ব নিয়েও পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার ৪–৮ শতাংশ; যা গবেষকদের ভাবায়।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, বাংলাদেশ এখন অনেকের কাছেই উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশে সরকারি প্রচেষ্টার বাইরে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এ হারকে আরো বৃদ্ধি করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবাই সাক্ষর হলেই পূরণ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। সাক্ষরতার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক একবিন্দুতে প্রোথিত রয়েছে। এটা শ্রবণসুখকর যে, বাংলাদেশে ক্রমেই সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবৃদ্ধিমান সাক্ষরতার হারের ফলে দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং দীর্ঘস্থায়ী কর্মহীনতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়। দ্রুত পরিবর্তিত প্রযুক্তিনির্ভর আমাদের এই বিশ্বে, এটি অপরিহার্য যে ব্যক্তিগতভাবে নিজ জ্ঞানকে ক্রমাগত প্রসারিত করে এবং পরিবর্তনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে, যার জন্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আধুনিক এ বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে সাক্ষরতার গুরুত্ব অপরিসীম।