বাংলা গানের জন্ম বাংলা ভাষার সাথেই। বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য হল চর্যাপদ। তার পরে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, শ্যামাসংগীত, কবি গান, টপ্পা, খেয়াল ও টপ খেয়াল, ধ্রুপদ ও ঠুংরি। বাংলা ভাষায় রচিত গান দুই ধরনের, এক–লোকসংগীত আর দুই–নাগরিক সংগীত। এই নাগরিক সংগীতই আধুনিক বাংলা গান।
প্রগতিশীল চিন্তা প্রসূত যুগদাবী অনুযায়ী রচিত গান আধুনিক গান। জীবন ও জগত সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, রুচিসম্মত ভাব, ভাষা ও আধুনিক সুর–তাল সমন্বয়ে এর উৎপত্তি। আঠারো শতকের শেষ ভাগে নিধুগুপ্তের টপ্পা গানের মাধ্যমে এর সূচনা। নরনারীর প্রণয় ভিত্তিক ভাব, প্রেমবিরহের কাহিনী এর ছিল মূল বিষয়।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে আকাশবাণী কোলকাতা থেকে ‘ভাব গীতি’ ও ‘কাব্য গীতি’ নামে নতুন যে গান প্রচারিত হত তাই মূলত আধুনিক গান। এ গান কাব্য সংগীত নামেও পরিচিত। আধুনিক বাংলা গান প্রথম প্রচারিত হয় বিভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাপী যে সকল যুদ্ধ ও বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে তার ফলে বৈশ্বিক সমাজে এসেছে নানা রকম পরিবর্তন যার প্রতিফলন দৃষ্ট হয়েছে তৎকালীন শিল্প সংস্কৃতিতে। সংগীত শিল্পসংস্কৃতির অঙ্গ বিধায় সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের সুখ দুঃখ হাসি কান্না আনন্দ বেদনা এবং আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তব চিত্র এতে প্রতিফলিত হয়। তাই পরিবর্তনকালীন জীবনের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে নতুন রূপে যে সকল সংগীত রচিত হতে থাকে তা’ই আধুনিক গান। যে গানের কেন্দ্রে থাকে সৌন্দর্যের অনুভূতি, আনন্দ ও মানুষে মানুষে এক সাধারণ বন্ধনের স্বীকৃতি। দেশী বিদেশী ও আঞ্চলিক সুরের মিশ্রণে নিত্যনতুন সুর সৃষ্টি, পরিমিত বাক্যবিন্যাস দ্বারা বিষয় উপস্থাপন এবং দেশী বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
আধুনিক বাংলা গানের গোড়াপত্তন কোলকাতা শহরে। ঔপনিবেশিক শাসনে জীবন ধারণ তথা উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের পর্যন্ত কোলকাতার নগর জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের যে জোয়ার এসেছিল তার ফলে কোলকাতায় এক নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণের সৃষ্টি হয় এবং প্রতিভাবান সংগীতজ্ঞদের মিলিত প্রয়াসে বাংলার সংগীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
যে পথ ধরে বাংলা গানের বিবর্তনের ধারায় তৎকালীন বাংলায় ঐতিহাসিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে একটি সাংগীতিক নবজাগরণের পথ প্রসারিত হয়েছিল এবং উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে বাংলা গানে আধুনিকতার যে ছোঁয়া লাগল, শুরু হল বাংলা গানের নতুন অধ্যায় সে পথ ধরেই রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ ও কাজী নজরুল রচনা করে ছিলেন সব নতুন ধারার গান যা পঞ্চকবির গান নামে পরিচিত। সে সব গানে ঈশ্বরভক্তি, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ভাষা, নরনারীর প্রেম ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে।
সে সময় কোলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে দূর দূরান্ত থেকে যে সকল লোক এসেছিলেন ভাগ্যের অন্বেষণে এদের মধ্যে অবাঙালি সংগীতজ্ঞ ও কিছু মুসলমান সংগীতজ্ঞও ছিলেন। এদের কেউ ছিলেন কণ্ঠশিল্পী, কেউ যন্ত্রশিল্পী। এই শিল্পীদের নিয়ে উনিশ শতকে আধুনিক বাংলা গানের উদ্ভব ও বিকাশ।
রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই মূলত আধুনিক বাংলা গানের গোড়াপত্তন ও পূর্ণতা প্রাপ্তি তাই রবীন্দ্রনাথকে সংগীতের দেবী স্বরস্বতির বরপুত্র বলা হয়।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত বাংলা গানের অজেয় সংগীতের অনন্য রূপকার। সুর লহরী ও অপরূপ বাণী, ভাব, ভাষার ব্যঞ্জনা আর কথার কারুকার্যে তিনি অসাধারণ সুর ও বাণীর সুসমন্বয়ক।
অনেক বিচারে অধ্যয়নে, বিবেচনায় বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের সামগ্রিক ধারায় আমরা দেখেছি এবং আগেও উল্লেখ করেছি রবীন্দ্রনাথ আধুনিক যুগের আধুনিক বাংলা গানের মূল প্রবর্তক। তিনি তার গানে সমাজ, দেশ, কাল, বিষাদ, বেদনা, হাস্যরস, বাউল, কীর্তন সুরের প্রয়োগ, আধ্যাত্মিক বোধ, মানবআত্মার সত্য প্রজ্ঞা, প্রেম, প্রকৃতি, টুমরীর প্রয়োগ, ব্যবহার, আধ্যাত্মিক আকুতি, গজল, লোকসংগীত, রাগ সংগীতের প্রয়োগ অনন্যসাধারণ ভাবে করেছেন।
আমরা আগেই বলেছি কাব্য গীতিই আধুনিক বাংলা গান। সমাজ ও মানুষের শিল্প ও সুর, সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আশা আকাঙ্ক্ষা এবং পরিবর্তিত জীবনধারার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আবেগ অনুভূতি নিয়ে নতুন আঙ্গিকে যা রচিত তাই আধুনিক গান। বিশেষত আধুনিক বাংলা গানের বিষয়ভূক্ত ছিল রোমান্টিকতা, নর নারীর প্রণয়, প্রেম বিরহের কাহিনী, প্রেমময় ভাব, মন, রাগ অনুরাগ, আনন্দ, বিচ্ছেদ, প্রাকৃতিক উপাদান, আকাশ, চাঁদ ফুল, মালা সমাধি, মেঘ, বৃষ্টি, বিরহ বেদনা, আশা নিরাশা, অমা, অন্ধকার, রাত জাগা, চলে যাওয়া, মনের বেদনা, ঘুম, দিন রজনী, রাত্রি, অশ্রু, নয়ন, চাহনী, অবয়ব, খোপা, রূপ, অংগ, চাওয়া পাওয়া, প্রিয়া, প্রিয়তম, ভালোবাসা, প্রেম বিরহ, নদী, জোয়ার ভাটা, সাগর, তরঙ্গ, ঢেউ, স্রোত, জোয়ার ভাটা, তুলনা, চন্দ্র সূর্য, রূপমুগ্ধতা, ঐশ্বরপ্রীতি, দেশপ্রেম, আবেগ, ক্ষুধা দারিদ্র্য, আশা নিরাশা, সমাজের ভাঙা গড়া, মুক্তি, স্বাধীনতা, বিপ্লব, বিদ্রোহ, আন্দোলন।
শিল্প দুই ধরনের আনন্দ দেয় মানুষকে–
এক– জীবনের দুঃখ, ক্লেশ দূর করে অসাড় স্নায়ুগুলোর জন্য একটা সুখের আশ্রয় সৃষ্টি করে।
দুই– স্নায়ুর ভেতর দিয়ে মনকে এক জাগরণের দিকে উসকে দেয়। বাস্তব জগত ও মানুষের জীবন এবং ভাবনার একটা অজ্ঞাত ও রহস্যময় দিক কে উদ্ঘাটিত করে।
ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত, প্রাধান্য ও এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার কারণে বাঙালির জীবন মননে ঘটে বিরাট পরিবর্তন। ফরাসী বিপ্লব প্রভাবিত পাশ্চাত্য সাহিত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শের কারণেও ঘটে যায় এক ধরনের নবজাগরণ।
ইংরেজ শাসনের অবসান থেকে আজ অবধি আধুনিক বাংলা গানের বিভিন্নমুখী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যাকে সচরাচর আধুনিক বাংলা গান বলে চিহ্নিত করি তাতে বহুলাংশে রোমান্টিকতা ব্যতিরেকে সমাজভাবনার ইশারা প্রায় অনুপস্থিত।
আমরা দেখেছি বাংলা গানের গোড়াপত্তন থেকে আজ অবধি আধুনিক বাংলা গানের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে সত্যিকার অর্থে সমাজতাত্ত্বিক কোন নিবিড় গবেষণা হয়নি ফলে এর পেছনের কারণটা আমরা কখনো জানতে পারব না। কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের যে সব দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আজো উজ্জ্বল, যাকে আমরা এখনো আদর করে স্বর্ণ যুগের গান বলি তার অংগে যুগের নানা বিষয়, উপাদান, অনুষঙ্গের পদচিহ্ন প্রায় অনুপস্থিত, বলতে হয় পরিপূর্ণ গরহাজির।
তিরিশের দশক থেকে বাংলা আধুনিক গান তার ভাব ও ভাষার ঘরানায় রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেছে, পরের দিকে কাজী নজরুল ইসলামের মানসিক
স্থবিরতা থেকে যে শূন্যতা, তার দখল নিয়েছেন যে গীতিকাররা, তাঁরা গানের ভাষা ও উপাদানে লিরিকধর্মী ও রোমান্টিক– কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সময়ভাবনার অভিক্ষেপ তাদের গানে তেমনভাবে পড়েনি।
দেশের মাটিতে স্বাধীনতার লড়াই যখন তুঙ্গে তখন ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়, আমার সমাধি পরে’, ‘চাঁদ কহে চামেলিগো’ বা ‘এমনই বরষা ছিল সে দিন’ এইসব আবেগী রোমান্টিকতায় ভরা শব্দ, ভাবপূর্ণ রচনা তখন বাংলা গানে ডানা মেলছে। স্বাধীনতার লড়াইয়ের সেই সময়কে আধুনিক বাংলা গান একটুও ধরতে পারেনি।
খুব কষ্ট করে মনে করা যায় একটা গান, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়/তুমি যে বহ্নিশিখা’। তবে এটা একটা ব্যতিক্রম বলে নিয়মকে প্রমাণ করে।
আরো মনে করব তিরিশ বছরে মাত্র তিনটি গানের কথা, যেখানে দেখা যাবে কিছু ব্যতিক্রমী উচ্চারণ–মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ পৃথিবী আমারে চায় ‘জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখা ও সুর, ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’। এটাকে কি ইতিহাসের ট্র্যাজেডি বা ট্র্যাজিক নিয়তি বলা যাবে না?
বাংলা গানের সমাজতত্ত্ব নিয়ে ভাবতে বসলে শুধু এইটুকু বললেই চলবে না। কেননা সমাজ কোন স্থায়ী বিগ্রহমুর্তি নয়, সময়ের সঙ্গে তা পাল্টে পাল্টে যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী যে সমাজবাস্তবতা প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছরে তার আদল কোনোভাবেই এক নয়।
আধুনিক বাংলা গানের মূলস্রোত যখন সময়ছুট হয়ে এক প্রেম প্রকৃতির রক্তহীন ধারায় নিমগ্ন, সেখানে তার অনেক জরুরি প্রশ্ন ‘ও কেন এত সুন্দরী হল?’ অথবা ‘ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নিশুতিরাত গুমরে কাঁদে’ কিম্বা ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’। শুধু এই কি বাঙলা গান?
ষাটের দশকে সারা পৃথিবী জুড়ে ভাঙচুর, নারী আন্দোলনে খোদ ইউরোপ আমেরিকা উত্তাল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে সারা দুনিয়ার জনমত মার্কিনিদের বিরুদ্ধে, জাঁ পল সাত্রের মত মানুষ পথেও নেমেছেন, আর বাঙলা গানে তখন গাওয়া হচ্ছে, ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’? ‘সেদিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যা’।
নাপাম বোমা দিয়ে কিভাবে মার্কিনি সেনা ধ্বংস করে দিচ্ছে ভিয়েতনামের গ্রামের পর গ্রাম অথচ কোলকাতা শহরে তখন বাঙলা সিনেমায় গাওয়া হচ্ছে ‘ তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার ’!
হায় হায় বাংলা গান, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?
সংগীত সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে বাংলা কাব্য সংগীত বা আধুনিক গানের নিজস্ব রূপ গড়ে উঠেছে।
পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের সংগীত সেই সব দেশেরই আদিম নাচ–গান বাজনারই ক্রমবিবর্তিত রূপ ছাড়া আর কিছু নয়। আদিম মানুষ ছিল সভ্যতা– পূর্ববর্তী সময়ের মানুষের পাশবিক অবস্থায়, সেখান থেকে তারা ধীরে ধীরে সভ্যতার দিকে এগিয়ে উন্নীত হয় সভ্যতার আদি অবস্থায়। আদিম গান প্রয়োগের ক্ষেত্র ছিল দু‘ধরনের– ধর্মীয় এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বা সামাজিক, মানুষ্য সমাজের অস্তিত্বরক্ষা, প্রাকৃতিক রোষ থেকে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত মুক্তি ও মংগলসাধনের জন্য আদিম মানুষরা উৎসর্গ অনুষ্ঠানের দ্বারা প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করত।
তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই অনুষ্ঠান ঘিরে তারা নাচ গান করত। যে গানের প্রকৃতি ছিল সরল। এই সকল সামাজিক গান থেকে জন্ম নিল লৌকিক গান।
সুতরাং সংগীতের সমাজতাত্তি্বক ব্যাখ্যা, সংগীতের সামাজিক ইতিহাসের পর্যালোচনায় সংগীতের জন্ম, উদ্ভব, বিকাশ ও প্রসারের সমাজ বাস্তবতার চিত্র, অনুসংগ, মানুষের সামগ্রিক জীবন যুগে যুগে কালে চিত্রিত হয়েছে সংগীতে সুরে তালে নৃত্যে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হরপ্পা মহেনজোদাড়োর ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত বাঁশী, মৃদঙ্গ, তন্ত্রীযুক্ত বীণা, করতাল, নৃত্য শীলা নারীমূর্তি, নর্তকের মূর্তি, চামড়ার বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি সংগীতের বিভিন্ন নিদর্শন থেকে।
সমাজ বাস্তবতাকে স্বীকার করেই, সময়ের স্রোতের ধারাকে ধরে, মানুষের জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, সুখ হাসি কান্নার আবহকে সংগীতে, সুরে বেঁধে রাখাই যুগের কালের দাবী পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যেটি বাংলা লোকসংগীতে, গণসংগীতে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে প্রেরণা জাগাতে সৃষ্ট, গীত শত দেশাত্মবোধক গান।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আধুনিক বাংলা গানের গোড়াপত্তন হলে এ গান যেভাবে সমাজকে, আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে, ১৯৪৭ এর পর বাংলা আধুনিক গানে সমাজের তেমন কোনও প্রতিফলন নেই। পরবর্তী কালেও এ গান সমাজকে বা জীপন যাপনের ক্ষেত্রে কোনও স্থায়ী ছাপ ফেলেছে এমন কথা জোর করে বলা যায় না।
আমরা আরও দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি হাজার বছরের বাংলা ভাষার প্রথম সংগীত ‘চর্যাপদ’ যা ছিল বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের সাধনসংগীত এবং যা রচিত হয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকে, তার ইতিহাস লেখা আছে, আবার বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন বড়ুচণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর ইতিহাস লেখা আছে কিন্তু এ যাবত বাঙলায় প্রকাশিত লেখালেখি ও বইপত্রে বাংলা গান ও সমাজের কথা কোথাও মেলে না।
সংগীতের ইতিহাস, সংগীতের সামাজিক ইতিহাস, সংগীতের সমাজতত্ত্ব, গানের ইতিহাস, ঘরানার ভূগোল, সমাজ ও নৃতত্ত্ব অনুপস্থিত, সংগীত জগতের সৃজনী শক্তির ইতিহাস বা ক্রিয়েটিভিটির হিস্ট্রি নেই, সমাজতাত্ত্বিকদের চোখে সংগীতের ক্রম বিবর্তন, সংগীতের ঘরানা, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সংগীত কিভাবে প্রভাবিত করেছিল তার ইতিহাস নেই। বাংলা গানের যে একটা ধারাবাহিক ইতিহাস থাকার কথা সেটি কোথায়? অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দীতে এসে যদি চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনি পাই তাহলে সংগীতের তথা আধুনিক বাংলা গানের ধারাবাহিক সামাজিক ইতিহাস কই?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগীত শিল্পী