মানবসভ্যতার ইতিহাসের শুরু আমরা যেভাবে পড়ি, সেভাবেই মনে করি আদিম যুগ ছিল অন্ধকার যুগ। সেই সময় মানুষ গুহায় বাস করত, পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত, আগুনের সাথে পরিচিত হচ্ছিল। ইতিহাসের অভিধান বলছে এ ছিল পশ্চাৎপদ ও পশুবৎ জীবন। কিন্তু প্রশ্ন হলো–আসলেই কি আদিম যুগ ছিল অমানবিক? নাকি আজকের একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্যতাই আসল জাহেলিয়াত?
আদিম যুগ: গুহার অন্ধকারে মানবতার আলো। গুহাবাসী মানুষের জীবন ছিল কঠিন। প্রকৃতির কাছে অসহায়, বন্য পশুর ভয়, অজানা রোগ সব মিলিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম ছিল নিত্যদিনের। কিন্তু তখনো মানবিক বন্ধন, পারস্পরিক সহযোগিতা ও একসাথে বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা ছিল তাদের জীবনের ভিত্তি। তাদের সমাজে ছিল না উপনিবেশবাদ, গণহত্যা বা পারমাণবিক বোমা। তারা প্রকৃতিকে ধ্বংস করেনি, বরং প্রকৃতির সাথে লড়াই করে সহাবস্থান করেছে।
আধুনিক সভ্যতার আসল মুখোশ: একবিংশ শতাব্দীকে আমরা বলি প্রযুক্তির যুগ, বিজ্ঞান ও উন্নয়নের বিস্ময়কর সময়। মানুষ মহাকাশে পৌঁছেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাল্টা সত্য হলো।
যুদ্ধ আজও পৃথিবীর রক্তাক্ত বাস্তবতা। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। মানবাধিকার আজ কাগজের বুলি, বাস্তবে শরণার্থীরা আধুনিক গুহাবাসী হয়ে বেঁচে আছে। ধর্মের নামে উগ্রবাদ, রাজনীতির নামে ক্ষমতাদখল আর অর্থনীতির নামে দাসত্ব আধুনিক সভ্যতার মুখোশের আড়ালে লুকানো।
আদিম বনাম আধুনিক: নির্মম তুলনা। আদিম মানুষ পশুর চামড়া পরে বাঁচত, আজ আমরা ব্র্যান্ডের নামে মানুষ হত্যা করছি। তারা শিকার করে খেত, আমরা কোটি কোটি টন খাদ্য নষ্ট করি, অথচ প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ অনাহারে মারা যায়। তারা গুহায় থাকত, আমরা আকাশচুম্বী অট্টালিকায় থেকেও একাকীত্ব, বিষণ্নতা আর আত্মহত্যার মহামারীতে ভুগছি। তাদের অস্ত্র ছিল পাথরের টুকরো, আমাদের অস্ত্র হলো পারমাণবিক বোমা, যা কয়েক মিনিটেই কোটি প্রাণ নিঃশেষ করতে পারে। সভ্যতার বিবর্তন নাকি পশ্চাদপদতা?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় রোমান সাম্রাজ্যের গ্ল্যাডিয়েটর খেলা, আইয়ামে জাহেলিয়াতের কন্যাশিশু হত্যার প্রথা ছিল মানবতার কলঙ্ক। কিন্তু আজকের দিনে ড্রোন হামলা, গণহত্যা, শিশু হত্যাযজ্ঞ ও জাতিগত নিধন সেই অমানবিকতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। মানুষ চাঁদে পৌঁছালেও পৃথিবীতে মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচাতে পারেনি।
আদিম মানুষ গুহায় থাকত, কিন্তু মানবতার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল। আর আমরা প্রযুক্তির আলোয় থেকেও মানবতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি।