পাহাড়ের মানুষগুলো সমতলে নামতে চায় আর সমতলের মানুষগুলো চাঁদ দেখতে চায় পাহাড়ের চূড়োয় ওঠে। এ নিয়ে অনিবার্য দ্বন্দ্বে একটি শিশু মারা যায়। শিশুটির চেহারার গড়ন অনেকটা পাহাড়িদের মতো, অনেকটা সমতলের মানুষদের মতো। উভয় পক্ষ শিশুটিকে নিজের দলের করে নিতে চায়, কিন্তু কেউই কলঙ্কের দায়ভার কাঁধে নিতে চায় না।
শিশুটির পরিচয় পাওয়া যায় না। অতটা ছোট নয় শিশুটি যে সংঘাতস্থলের দিকে কৌতূহলে দৌড়ে আসতে পারবে না, আবার এতোটা বড়ও নয় যে ভয়াবহতা দেখে ভয় পেয়ে পালাতে পারবে। কোথা থেকে এসেছে শিশুটি? সবাই সবার মুখের দিকে চায়। যে এগিয়ে গিয়ে চায় শিশুটির দিকে, তারই মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। নিজের ভেতর লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে যায়। কেউ আর সাহস করে বলে না এটি আমাদের সন্তান। কিন্তু চিন্তায় পড়েন আদিবাসী নেতারা। অবিকল তাদের চেহারার মতো দেখতে এ কোন আজব শিশু এল যুদ্ধের মাঠে প্রাণ দিতে? আবার সমতলের নেতৃবৃন্দ নিজেদের নত মাথা উত্তোলন করতে পারে না, কারণ তারা দেখে অবিকল তাদেরই চেহারা ফুটে আছে শিশুটির অবয়বে। তখন সংঘাত বন্ধ করে দু দলের নেতারা আলোচনায় বসেন এবং লাশটি কার ঘরে যাবে তা নিয়ে নতুন করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করেন। লাশটি যে আদিবাসী নারীর এবং সমতলী পুরুষের এ কথা আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেও দায় স্বীকার করছেন না কেউ। আবার পাহাড়ি লোকেরা চায় লাশটি তাদের পক্ষে টানতে, কেননা সমতলের লোকদের মতো তাদেরও ধারণা লাশ যার পক্ষে মামলাও তার পক্ষে থাকবে। এ ব্যাপারে পাহাড়িদের একেকটা নওজোয়ানকে ধরে এনে জিজ্ঞাসা করা হয় এবং তাদের সবার নিরুত্তর অথবা প্রবল অস্বীকৃতিমূলক জবাব আদিবাসী নেতাদের ভাবনা আরো গভীর করে। তার ওপর অপবাদ নেতাদের ওপর থেকেও যাওয়ার আশঙ্কা নেই, কারণ তাদের চেহারার সাথেও শিশুটির চেহারার মিল আছে। তখন সমতলের নেতারা তাদের প্রত্যেক যৌবনপ্রাপ্ত যুবকদের ডেকে আনেন এবং জিজ্ঞেস করেন, ভয় নেই, এই কাজ কি তুমি করেছ?
যুবকেরা ডানে–বামে মাথা নাড়লে নেতারা আবার একে অপরের মুখের দিকে চান। ভাবেন, তার আপন চেহারার সাথে যে শিশুটির চেহারার অবিকল মিল আছে তা অপর নেতারা বা সাধারণ মানুষজন বুঝতে পারে কিনা।
লাশ যাদেরই হোক, দু দলের নারীরাই চাইছিল লাশটি যেন সমাহিত করা হয়। অমন চাঁদবদন শিশুটি রক্তাক্ত অবস্থায় ঘাসের উপর পড়ে থাকবে এটি যেন মাতৃজাতির বুকের রক্ত ঝরার মতোই। তারা তা সহ্য করতে পারে না। তারা দুই হাতে চোখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সে কান্না ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি বিলাপে রূপান্তরিত হলে চাষিদের কাস্তে থেমে যায়। লাঙলের ফলা থেমে যায় জোয়াল কাঁধের গরুগুলোর ক্লান্তিতে। রান্না ভুলে যায় মায়েরা। আর পাহাড় ও সমতলের বালিকারা উদাস চোখে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ঠায় অতিক্রম করে সময়ের পর সময়। আর তাদের হাতের কাঁকন ভেঙে যায় একটানা শরীরের ভার দিয়ে খুঁটির সাথে ঠেস দিয়ে দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এবং সে চুড়ি ভেঙে তাদের নবীন বাহুলতায় রক্তস্রোত প্রবাহিত করলেও তারা টের পায় না। তাদের পায়ের কাছে পোষা প্রাণীগুলো কেঁদেকেটে মরে গেলেও তাদের উদাস দৃষ্টি ফেরে না দিগন্ত থেকে। পাহাড় আর সমতলের নারীরা তখন দলবদ্ধভাবে লাশটিকে শেষকৃত্যের দিকে নিয়ে যেতে এগুতে থাকলে দু দলের পুরুষেরাই তাদের বাধা প্রদান করে। তাদের হাতে আবার চুড়ি পরিয়ে তাদেরকে ঘরে পাঠায়। ঘরে গিয়ে নারীরা তাদের নিজ নিজ ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগুন নেভাতে দু পক্ষের লোকেরাই দৌড়ে আসে এবং আপন আপন বিপদ বাঁচিয়ে তারা অন্যের বিপদেও সাহায্যের হাত বাড়ায়। দেখা যায় ঝর্ণার ঝিরি হতে জল বহন করে নিয়ে আসছে পাথরপেশির আদিবাসী যুবকেরা এবং স্বয়ং নদীটির গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে সমতলের তরুণরা। তারা পাহাড়িদের আশ্রয়স্থল বাঁচানোর জন্য নিজের গায়ে আগুনের উত্তাপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে লেলিহান শিখায়, নিজের জীবনের বাজি রেখে বের করে আনছে দুধের শিশু। আবার আদিবাসী যুবকেরাও নরককুণ্ডের মতো আগুনে পুড়তে থাকা সমতলের ঘরবাড়িগুলোর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নির্ভীক এবং বের করে আনছে মানুষ নামের স্বর্গ। এদিকে আগুন নেভাতে নেভাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলে আবারও দু পক্ষের লোকদের লাশটির কথা মনে হয়। শিশুটির লাশের খবর এতক্ষণ তারা রাখেনি, কারণ সপরিবারে লাশ হওয়া থেকে তারা রক্ষা পেতে সংগ্রাম করেছে পরস্পর পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এখন আবার বিচ্ছিন্নতায় দু জায়গার মানুষ দু জায়গায় ফিরে গেলে তাদের আবার শিশুর লাশটির কথা মনে হয় এবং তিলমাত্র বিলম্ব না করে তারা আবার লাশটির কাছে ফিরে আসে।
সবুজ ঘাসের উপর পড়ে আছে লাশটি। ম্লান রোদে কেমন যেন হাসছে শিশুটির মুখ। তার বুকে একটি বুলেট আর আরেকটি তীর বিদ্ধ। দুটোই বুকের ডান পাশে, বাম পাশে। সামনে পিছে হলে বোঝা যেত হয়তো সে পাহাড় থেকে আসছিল, তাই বুকে গুলি লেগেছে। অথবা ভাবা যেত হয়তো সে সমতল থেকে আসছে, তাই বুকে লেগেছে তীরের ফলা। কিন্তু কোনোটিই ধরার উপায় নেই। একই সমান্তরালে একটি বুলেটের ক্ষত আর একটি বিষ মাখানো তীর বিঁধে আছে বুকের দু পাশে, যেন কোনো তদন্তকারীকে উচ্চতা থেকে নামা আর নিচু থেকে উপরে আরোহনের তারতম্যও সে দেবে না, এমনই সমান্তরাল দুটি আঘাত। তাহলে কে যাবে লাশের সাথে কবরস্থানে অথবা চিতাশালায়। বিকেলটা আরও দীর্ঘ হয়। এবার পুরুষেরা নিজ নিজ রমণীকে আগুন আর আতঙ্কের কাছ থেকে নিরাপদে বেঁধে আসে। ফলে তারা আবার ফিরে আসতে পারে লাশটিকে সৎকার করতে। আদিবাসী নেতারা সন্ধি প্রস্তাব দেন, লাশটি আপনাদের; নিয়া যান। সমতলের লোকেরা সে সন্ধির অন্দর পর্যন্ত দেখে বলে, আপনারাই নিয়া যান; আপনাদের লাশ। দু দলের কেউই নিজেদের ভেতর এ ব্যাপারে ঐক্যে আসতে পারে না যে, এই কাজটি তার দলের কোনো যুবক করেনি। আবার দু দলের প্রত্যেকেই চায় যে, শিশুটির লাশ তাদের পক্ষে যাক, কেননা লাশ যার মামলা তার। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিতে আরও দেরি করে।
দেখতে দেখতে রাত নেমে আসে। সন্ধ্যা পেরিয়ে ঘুমটা টানা মৃত্যুকণ্ঠী উপকণ্ঠে দু দলই তাদের উপস্থিতি তখন বাহুল্য বোধ করতে থাকে। কোথাকার কোন সন্তান, কার না কার সন্তান? এ নিয়ে দু দলের অবস্থা তখন শিথিল পর্যায়ে। কিন্তু সবার মধ্যে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, সন্তান যারই হোক, পাহাড়ের কিংবা সমতলের, এতদিন নিজেদের পরিপার্শ্বে তাকে কেউ দেখেনি কেন?
এ বিস্ময় শেষ হতে রাত আরও গভীর হয়। তারা তখন ভয় পায়। একজন, দুজন পালাতে শুরু করে লাশের পাশ থেকে। এমনিভাবে সমতলের লোকেরা, পাহাড়ের লোকেরা একজন, দুজন, তিনজন করে যেতে থাকলে মধ্যরাতের আগেই প্রায় শূন্য হয়ে উঠে শিশুর লাশ পড়ে থাকা উপকণ্ঠ। শুধু দু দলের নেতারা তখনও ঝিমান। অবশেষে তাদেরও ঝিমানি শেষ হয়। তারাও ঘরে ফিরতে শুরু করেন। থাক পড়ে লাশ, শেয়াল অথবা নেকড়ে টেনে খাবে, তার জন্য ঘুম নষ্ট করে লাভ কী। তখন নিঃশেষে বিভাজ্যতায় অন্ধকার আরও ঘণীভূত হলে নিঝুম অমানিশা হতে হঠাৎ করে উদয় হয় দুটি মানব ছায়া। একটি রমণীর, আরেকটি পুরুষের বোঝা গেলেও কে সমতলের আর কে পাহাড়ের তা ঠাহর করা যায় না। তারা রাতের নৈঃশব্দ্য না ভেঙে লাশটির কাছে এগিয়ে আসে এবং চোখের জলে শেষ গোসল করিয়ে নিজেদের বুকের মধ্যে দাফন করে।