চট্টগ্রাম বন্দরের গাড়ির চাপ সামলাতে প্রায় আটশ কোটি টাকা ব্যয়ে আট লেনে উন্নীত করা হচ্ছে বন্দর টোল রোড। একই সাথে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টোল রোডকে যুক্ত করা হচ্ছে বে টার্মিনালের সাথে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট অংশে একটি লুপ নির্মাণ করে বিদ্যমান জট নিরসনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের জন্য অত্যন্ত জরুরি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়ছে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমাণও। প্রতিবছরই প্রবৃদ্ধি ঘটছে বন্দরে। বর্তমানে ৩৩ লাখ টিইইউএস এর বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। আগামী বছর কয়েকের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর পঞ্চাশ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করবে। এছাড়া আগামী ১৫ বছরের মধ্যে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমাণ এক কোটি ছুঁই ছুঁই হবে। দেশের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে আমদানি রপ্তানি। একই সাথে প্রতিবেশী দেশে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হলে এই কার্যক্রম প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাবে। বন্দর কেন্দ্রিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সাথে সাথে চাহিদা মেটানোর জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানা ধরনের প্রকল্প। আগামী একশ’ বছরের বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বে টার্মিনালকে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং কন্টেনার মোভার যাতায়ত করে। বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে এসব গাড়ি দেশের নানা স্থানে যায়, আবার একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান পণ্য নিয়ে বন্দরে আসে। একই সাথে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিগত বাহনও বন্দরে যাতায়াত করে। বন্দর কেন্দ্রিক যানবাহনের বিশাল চাপ সামাল দেয়ার জন্য বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল থেকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সন্নিকটে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত ১২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়। যাতে বিশ্বব্যাংক ব্যয়ে করে প্রায় একশ’ কোটি টাকা। রাস্তাটির কাজ শুরু করা হয় ২০০২ সালে। ২০০৭ সালে রাস্তাটি চালু করে দেয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী রাস্তাটি টোল রোডে পরিণত হয়। অত্যন্ত স্বল্পহারে টোল আদায় করা হয় রাস্তাটিতে। বর্তমানে একটি প্রাইমমুভার বা ট্যাংক লরি থেকে ৪৫ টাকা, কাভার্ড ভ্যান ৩৫ টাক, ট্রাক ২০ টাকা, ছোট ট্রাক ১৫ টাকা এবং প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য গাড়ি ৫ টাকা হারে টোল আদায় করা হয়। প্রথমদিকে রাস্তাটির ব্যবহার কম থাকলেও বর্তমানে বন্দর কেন্দ্রিক গাড়ির বিশাল একটি অংশ এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। এই রাস্তা দিয়ে বর্তমানে দৈনিক চার হাজারেরও বেশি গাড়ি চলাচল করে বলে টোল রোডের টোল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান জেএসআইসি-সেল কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার সাদ্দাম হোসাইন উল্লেখ করেন।
সূত্র জানায়, আজ থেকে বিশ বছরেরও বেশি সময় আগে বন্দর টোল রোডের জন্য নেয়া প্রকল্পে ভবিষ্যতের চিন্তা করা হয়নি। রাস্তাটি মাত্র দুই লেনের। ২৪ ফুট প্রস্থ রাস্তাটি বর্তমানের গাড়ির বিশাল চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আউটার রিং রোডের সাথে এই টোল রোড যুক্ত করে দেয়ায় রাস্তাটি দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার বাড়তি গাড়ি চলাচল করছে। ভবিষ্যতে রাস্তাটিতে গাড়ির চাপ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। বে টার্মিনাল চালু হলে এই রাস্তাটির উপর চাপ কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে সূত্র মন্তব্য করেছে।
বন্দর কেন্দ্রিক গাড়ির চাপ সামলানো, বে টার্মিনালের গাড়ি চলাচল এবং আউটার রিং রোডের গাড়ির সুবিধা নিশ্চিত করতে দুই লেনের বিদ্যমান টোল রোডকে আট লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সড়কটি নির্মাণে শুধু আগামী পঞ্চাশ বছরের লক্ষ্যকেই সামনে নেয়া হয়নি, একই সাথে বিশ্বমানের পরিকল্পনাকেও সামনে রাখা হচ্ছে। আটশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে বারো কিলোমিটার দীর্ঘ টোল রোডের ফৌজদারহাট থেকে শুরু করে প্রথম আট কিলোমিটারকে আট লেন এবং বন্দর অংশের পরবর্তী সাড়ে চার কিলোমিটারকে ছয় লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। অবশ্য এরমধ্যে দুই লেন সার্ভিস লেন হিসেবে থাকবে। বাকি ছয় লেন এবং চার লেনেই গাড়ি চলাচল করবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এই সড়কটির উন্নয়নে অর্থায়ন করছে। সড়কের ফৌজদাহাট অংশে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে বর্তমানে রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি পারাপার করে। এতে প্রায় সময় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থার অবসানে ফৌজদারহাটে একটি ‘ইউ’ লুপ নির্মাণ করা হবে। যাতে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করেই টোল রোডে গাড়ি প্রবেশ ও বের হতে পারে। বে টার্মিনালকে টোল রোডের সাথে যুক্ত করতেও একটি ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। যাতে আউটার রিং রোডে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করেই বে টার্মিনালের সাথে টোল রোডের গাড়ি চলাচল করতে পারে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রকল্পটি চূড়ান্ত করেছে।
এই ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রকল্পটি গ্রহণের কথা নিশ্চিত করে বলেন, টোল রোডে যে পরিমাণ গাড়ির চাপ, ভবিষ্যতে বে টার্মিনাল কিংবা আউটার রিং রোড়ের গাড়ির চাপ চিন্তা করেই এখন থেকে আমাদেরকে বড়সড় প্রকল্পটি নিয়ে কাজ শুরু করতে হচ্ছে। সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্পটি নিয়ে আগ্রহী। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য অগ্রসর হচ্ছি।