ভাষা হচ্ছে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম যা মানুষের বাগ্ ধ্বনি থেকে সৃষ্টি হয়। মানুষের ভাষাই হলো তার আত্মা এবং তার আত্মাই হলো ভাষা। ভাষা মানুষের সৃষ্টি ঈশ্বরের নয়। ভাষা হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সেতু। আর যে ভাষা একটি দেশের অঞ্চলবিশেষের কথ্য ভাষা তাকেই মূলত আঞ্চলিক ভাষা বলে।
প্রত্যেক দেশেই বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্য কথার টানে, উচ্চারণে এবং শব্দের রূপে দেখা যায়। জিহ্বার জড়তা, বিশেষ ভঙ্গিতে ধ্বনি ও শব্দ উচ্চারণ অন্যান্য অঞ্চল বা দেশের সঙ্গে মেলামেশা, স্থানীয়ভাবে কিছু কিছু শব্দ সৃষ্টি বা সৃষ্ট শব্দের ব্যবহার, জলবায়ু, আবহাওয়া ইত্যাদি কারণে আঞ্চলিক ভাষা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় পার্থক্য আছে। যেমনু
চট্টগ্রাম জেলার পল্লী অঞ্চলে ‘অতিথি’–কে বলে ‘গর্বা’। নোয়াখালী জেলার পল্লী অঞ্চলে ‘টাকা’–কে বলে ‘টেকা’, ‘খাব’–কে বলে ‘খামু’। ‘মেয়ে’ শব্দটি বিভিন্ন স্থানে ‘পুরি’, ‘মাইয়া’, ‘ছেমড়ি’, ‘ছেড়ি’, ‘ছোকড়ি’, রূপ লাভ করেছে। এই ধরনের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা।
আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো হল : (১)আঞ্চলিক ভাষা সাধারণত মৌখিক ভাষা। তবে, তার লিখিত রূপও পাওয়া যায়। ২) আঞ্চলিক ভাষা স্ব–স্ব অঞ্চলের উচ্চারণ ও বাক্য গঠনরীতি–নির্ভর। ৩) আঞ্চলিক ভাষা যে কোনো দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত।
সুতরাং আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা নয়। আমরা অনেক সময় নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলতে ইতস্তত করি। সাধু ভাষায় কথা বলাটাকে বেশি প্রাধান্য দিই। আমার অঞ্চলের ভাষায় কথা বলতে আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করি তাই এই ভাষায় কথা বললে কখনোই নিজে লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা ঠিক যে, অন্য অঞ্চলের লোকজন যদি আমার আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় সেক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক ভাষা প্রয়োগ করতে হবে। চট্টগ্রামের একজন হিসেবে কেউ যদি আপনাকে গম আছননি? এভাবে বলে তাহলে নিশ্চয়ই আপনার অনেক ভালো লাগবে। গম আছননি? কথাটির সাধু ভাষায় বললে বলা যায় কেমন আছেন? আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা রয়েছে।
আমরা সবাই যার যার আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে নিশ্চয়ই গর্ব করতে পারি। অঞ্চলভেদে ভাষার তারতম্য থাকলেও আমরা বিষয়টি বেশ উপভোগ করি।
বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই হলো বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন। যাদের রয়েছে নিজস্ব শব্দকোষ ও রীতি। যা বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করছে। শুধু কথায় নয়, প্রাচীন যুগ থেকে আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা, গান, সাহিত্য বা নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ তো করেন–ই না, বরং হীনম্মন্যতায় ভোগেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা বা অনাধুনিকতা নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য। তাই ভাষার এই বৈচিত্র্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেলে আমাদের সংস্কৃতির বিকাশও পথ হারাতে বাধ্য।
আঞ্চলিক ভাষা আমাদের শেকড়ের ভাষা। একজন মানুষকে দিনশেষে তার শেকড়ের টানেই ফিরতে হয়। আমাদের কথা বলায় যত আঞ্চলিকতার টান থাক না কেন তা কিন্তু আমাদের মায়েরই ভাষা। আধো আধো বোলে আমরা প্রথমে মায়ের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করি। এরপর ধীরে ধীরে আমার আপনার ভাষা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠে আঞ্চলিক ভাষা। আমরা শিশুকাল থেকে আমাদের মধ্যে গেঁথে নিই আঞ্চলিকতাকে।
আঞ্চলিক ভাষায় আমরা নিজেদের উদারভাবে তুলে ধরতে পারি। বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আমাদের সম্মুখে সেই অঞ্চলের পরিচয় তুলে ধরে। প্রতিটি দেশেই অঞ্চলভিত্তিক নিজস্ব ভাষা রয়েছে যা আমাদের একেবারে প্রাণের ভাষা। আমরা কোথাও গিয়ে নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করি। যদি সেই মুহূর্তে নিজ জেলার কাউকে পাই তাহলে প্রাণ খুলে কথা বলে মনের স্বাদ মিটিয়ে নিই। সুতরাং মনে কোনো সংকীর্ণতা না রেখে আমরা আমাদের আঞ্চলিকতাকে ভালোবাসবো কেননা আঞ্চলিক ভাষাতেই আমাদের আত্মপরিচয়।
লেখক : কবি, গল্পকার