‘চাটগাঁইয়া সহজ পাঠ’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি মূল্যায়ন বিষয়ক কর্মশালায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। চাটগাঁ ভাষা পরিষদের উদ্যোগে একে খান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট গবেষকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত গবেষক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক রচিত ‘চাটগাঁইয়া সহজ পাঠ’ গ্রন্থটির আলোচনায় বক্তারা বলেন, আঞ্চলিক ভাষা যে কোনো জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশে এ উপভাষাটি ব্যবহার হয়ে আসছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্যই চট্টগ্রামের উপভাষাটি সংরক্ষণ জরুরি।
পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭,১১১ টি ভাষায় মানুষ আজ কথা বলেন। ভাষাবিদদের মতে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মাত্র ২৩ টি ভাষা তাঁদের কথা বলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। তবে বিশ্বে বর্তমানে শতকরা ৪০ ভাগ ভাষা এখন প্রায় বিপন্ন। অর্থাৎ ২৮৯৫ টি ভাষা পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকায় আছে এবং অনেকগুলো এরই মধ্যে হারিয়েও গিয়েছে। ভাষা যেমন গতিময়, তেমনি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। ভাষা হারিয়ে যাবে, আবার বহুল ব্যবহারের কারণে কোনো কোনোটি উঠে আসবে নতুন স্রোতে।
বাংলা ভাষা পৃথিবীতে সপ্তম প্রধান ভাষা। কোনো কোনো সূত্র পঞ্চম প্রধান ভাষা হিসেবেও বলছে বাংলাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে ২৬ কোটি ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। সাধারণত বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করা বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। বাংলা ভাষা দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে। আনন্দের বিষয়, আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, পৃথিবীর শতকরা ৮৮ ভাগেরও বেশি মানুষ তাঁদের স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন।
মামুন অর রশীদ তাঁর ‘আঞ্চলিক ভাষা মানে প্রান্ত নয়’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেছেন, প্রমিত ভাষা হলো সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটি মানসিক চুক্তি, যা যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে সহজ করে। প্রাতিষ্ঠানিক কারণে প্রমিত ভাষা লিখিত ও দৃঢ় রূপ পায়। দাপ্তরিক কাজকর্ম, শিক্ষাদান ও গণমাধ্যমে ক্রমশ ব্যবহৃত হতে হতে প্রমিত ভাষাই একটি ভাষার প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠে। তবে আঞ্চলিক উপভাষাগুলোই একটি ভাষার মূল রস বহন করে। মানুষ মূলত ঘরে পারিবারিক পরিমণ্ডলে আঞ্চলিক ভাষায় আলাপ করে। আঞ্চলিক ভাষাগুলো কখনোই প্রমিত ভাষার উপদল নয়। প্রশাসনিক কাঠামোর ভাষা হওয়ার কারণে বা সবার সঙ্গে সবার কথা বলার ভাষা তথা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হওয়ার কারণে কখনো অনেকের কাছে প্রমিত ভাষাকে ‘কেন্দ্রীয় ভাষা’ মনে হতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রপ্রান্ত এমন ধারণা আসলে যুগ্ম বৈপরীত্যপ্রসূত। প্রকৃত কথা হলো, প্রমিত ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সম্পর্ক সমান এবং ভাষাবিজ্ঞানে কোনো ভাষার মর্যাদার তারতম্য করা হয় না, সবই সমান।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সম্পদ তার আঞ্চলিক ভাষার সৌন্দর্য। অসাধারণ সব শব্দের বিন্যাস নিয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের ভাষার সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। একই শব্দ কত রকমভাবে ব্যবহৃত হয় এবং তা কতটা মধুর শোনায়, তা কেবল প্রতিটি অঞ্চলে গেলেই দেখা ও শোনা যায়।’
আমরা সচেতনভাবে লক্ষ্য করি, সাহিত্যে– বিশেষত কবিতায়, গানে, গল্প–উপন্যাসে ও নাটকে যুগ যুগ ধরে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হয়ে আসছে। আবুল ফজল, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমানের মতো লেখকরা আঞ্চলিক ভাষায় অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, এই আঞ্চলিকতার কারণে বাংলা ভাষা আরও নতুন নতুন শব্দে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষার সাথে মান ভাষার কোনো বিরোধ নেই। আঞ্চলিক ভাষার এই বৈচিত্র্য ভাষাকে শক্তিশালী করে, সমৃদ্ধ করে। তবে আঞ্চলিক ভাষার একটা শুদ্ধ রূপ আছে, যেটা সাহিত্যে এলেও ক্ষতি নেই।’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা এবং শোনা যতটা সহজ ও শ্রুতিগ্রাহ্য, ততটা কঠিন তার লৈখিক রূপ। কাজ এতো কঠিন হলেও এর চর্চা কম নয়। এই ভাষায় ছড়া লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন অনেকে। আমাদের অফিস–আদালতের ভাষা, গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থার ভাষা হলো প্রমিত। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে, আমরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারবো না। প্রমিত বাংলা জানাটা যেমন দরকার, আমাদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষাও ঠিক ততটাই জানা দরকার। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। ভাষাবিদরা বলেন, কোনো কারণে আঞ্চলিক ভাষার এ প্রাচুর্য যদি হারিয়ে যায়, তবে তা হবে আমাদের জন্য বড় ধরনের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক বিপর্যয়। এই ভাষা সংরক্ষণ করতে প্রতিটি এলাকায় আলাদা ভাষা সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন।