চট্টগ্রামের সর্বাধিক প্রচারিত ও বিক্রিত একমাত্র পত্রিকা দৈনিক আজাদী আজ ৬৫তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একমাত্র ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়া আর কোনো পত্রিকা একনাগাড়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত হওয়ার নজির নেই। ইত্তেফাক আজাদীর অন্তত আট বছর আগে প্রকাশিত হয়ে এখনও প্রকাশনার ধারা অব্যাহত রেখেছে। তবে ইত্তেফাকের শরীরে দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি সুস্পষ্ট। আজাদী কিন্তু ৬৫ বছরেও প্রথম দিনের ন্যায় তেজী এবং যৌবনদীপ্ত। অবাক হয়ে যাই মালেক ভাইয়ের সুদক্ষ পরিচালনায় ও পথনির্দেশনায় আজাদী কিভাবে বার্ধক্য ও তারুণ্যের তেজে টগবগ করে ছুটছে। পত্রিকার চেয়ে তিনি ১৯ বছরের বড়। তাঁর জীবন–সূর্য আশি পেরিয়ে পশ্চিমের পাটে হেলে পড়লেও আজাদীতে তরুণ রক্ত সঞ্চার করে তাঁকে যোগ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র ওয়াহিদ মালেক।
আজাদী চট্টগ্রামের কণ্ঠস্বর, অহংকার; আজাদী চট্টগ্রামের মুখপত্র। আজাদীর ভাষায় চট্টগ্রাম কথা বলে। চট্টগ্রাম বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, বঙ্গোপসাগর, কিংবদন্তির নদী কর্ণফুলি ও মা মাছের অভয়ারণ্য হালদা নদী এবং প্রায় ন্যাড়া হয়ে আসা চট্টগ্রামের উঁচু নিচু পাহাড় যেমন চট্টগ্রামের গর্বের বস্তু, তেমনি দৈনিক আজাদীও একটি গর্বের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আজাদী শুধু একটি পত্রিকা নয়, আজাদী একটি প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। আজাদীর জন্মদিনে এই দীর্ঘজীবী পত্রিকাটির জনক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, দীর্ঘদিনের সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, তাঁর পরবর্তী সম্পাদক এমএ মালেক এবং ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পৌত্র ও উত্তরসূরী জনাব ওয়াহিদ মালেকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আজাদীর বয়সকালে চট্টগ্রাম আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ির রাস্তায় চলছে রিক্সা, সিএনজি ট্রাক, বাস, কার, মাইক্রো ইত্যাদি। আজাদীর প্রায় সাড়ে ছয় দশক সময়সীমার মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। আইয়ুবের ওজিএল–এর কল্যাণে একটি নব্য ধনিক শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। দেশ পরিবর্তন হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, চট্টগ্রাম নব্য স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে আজাদীর প্রতিষ্ঠা– সময়ে প্রলয়ংকরী সাইক্লোনে চট্টগ্রাম সহ দেশ বিরান হয়ে যায়। আজাদীর সংবাদ কর্মীরা সেই ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ নিপুণ মুন্সিয়ানায় পরিবেশন করে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন দেশের কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি, তখন চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র দৈনিক আজাদীই আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গী হয়ে স্বাধীন দেশের প্রথম সংবাদপত্র হওয়ায় গৌরব অর্জন করেছিলো।
আজাদীর হাত ধরে চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা বিকশিত হয়েছে। পঞ্চাশের দশকেও চট্টগ্রামে সংবাদপত্র ছিলো নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার স্থল। সে সময় দেশভাগের ফলশ্রুতিতে ভারত থেকে মোহাজের সাংবাদিকরা এসে রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের শীর্ণ দেহে নতুন রক্তের সঞ্চার করেছিলেন। তবুও যতক্ষণ ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে আজাদী প্রকাশিত হয়নি, ততক্ষণ চট্টগ্রামে একটি পেশাদার সাংবাদিক শ্রেণি গড়ে ওঠেনি।
সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব আজাদীর একটি বিশিষ্ট অবদান। আজাদী প্রকাশের পূর্বে সাংবাদিকতা করে পরিবারের ভরণপোষণ নির্বাহ করা যাবে এটা ভাবা যেত না। সেজন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ ডিঙিয়ে যেসমস্ত যুবক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরি সন্ধানে ঘোরাফেরা করতেন, তাদের কাছে সংবাদপত্র চাকরির প্রথম পছন্দ হিসেবে প্রতিভাত হতো না। সবাই হাবিবুর রহমান খান, মঈনুল আলম, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী, বিএ আজাদ ইসলামাবাদী, নজির আহমদ, বেলাল বেগ হন না।
আজকের মত আজাদীর ৫৬তম জন্মদিনে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম; বলেছিলাম : চট্টগ্রাম ইতিহাসের আঁতুর ঘর। চট্টগ্রাম বারবার ইতিহাস সৃষ্টি করে। সাংবাদপত্রের আলোচনায় সংবাদপত্র থেকেই উদাহরণ টানা যাক। বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। পত্রিকার নাম ‘জ্যোতি’। ১৯২১ সালে জেলা কংগ্রেস সভাপতি চট্টল গৌরব মহিমচন্দ্র দাশের সম্পাদকতায় এটি প্রকাশিত হয়। আদিতে পত্রিকাটি ছিলো সাপ্তাহিক; ১৯২০ সালেও এটি সাপ্তাহিক রূপে প্রকাশিত হয়েছিলো। সম্পাদক কালী শংকর চক্রবর্তী। ১৯২১ সালে তিনি পত্রিকাটি কংগ্রেসের হাতে সমর্পণ করেন। তখন তিনি এটি সম্পাদনার ভূমিকা ত্যাগ করে প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এভাবে বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক প্রকাশ করে চট্টগ্রাম একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলো।
জ্যোতির প্রকাশের সালটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো গবেষক এদিকে দৃষ্টি দিলে আরো মূল্যবান ইতিহাসের সন্ধান পেলেও পেতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকে যাঁরা বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা কেন ১৯২১ সালকে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ ১৯২১ সালে অনেকগুলো ঘটনা ঘটবে। অনেক ইতিহাস সৃষ্টি হবে। আসন্ন ইতিহাসের ঘনঘটা অনেকটা জেনে এবং কিছুটা অনুমান করে তারা সে ইতিহাসের বাহন হিসেবে একটি দৈনিক প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ তাঁরা নিজেরাও ছিলেন ঐ ইতিহাসের নির্মাতা। ১৯২১ সালে গান্ধীজী তাঁর অভূতপূর্ব অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের দুন্ধুভি বাজিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন; কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে অসহযোগ প্রস্তাব পাস হবার পূর্বেই চট্টগ্রাম থেকে অসহযোগের ঘণ্টা বাজিয়ে দেবেন মহিম দাশ, ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী, শেখ–এ–চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা; আর তা’ শুনে পুলকিত গান্ধীজী ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে চট্টগ্রামকে এই বলে অভিনন্দন জানাবেন যে, “Chittagong to the fore.” একই বছর দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ও বিওসি ধর্মঘট আহ্বান করে ভারত ইতিহাসে নতুন উপাদান সংযোজিত করবেন। ইতিহাসের সন্ধিকাল সেটা; এক একটা ঘটনা ঘটছে আর ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাচ্ছে। সুতরাং, ১৯২১ সালে যে দৈনিক জ্যোতি প্রকাশিত হলো, সেটা নিছক সংবাদপত্র নয়, আদর্শের বাহন, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের শঙ্খধ্বনি, তূর্যনিনাদ ঘোষণা করেছিলো জ্যোতি।
জ্যোতি যে আলো জ্বালালো, সে আলোকিত পথ ধরে অনতিকাল পরে প্রকাশিত হলো পাঞ্চজন্য। সেটি আরেকটি রাজনৈতিক সংবাদপত্র। ত্রিশ–চল্লিশের দশকে আরো পত্রিকা প্রকাশিত হলো যেমন নিলাম ইস্তাহার সুনীতি, সত্যবার্তা, আজান, এবং ১৯৪৬ সালে সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম, যিনি পরে জমানা পত্রিকা প্রকাশ করবেন, তাঁর চাচাত ভাই কবি আবদুস সালাম প্রকাশ করলেন দৈনিক ‘পূর্ব পাকিস্তান’। লক্ষ করবার বিষয় ‘পাকিস্তান’ নয়, তিনি বার করলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান’। পূর্ব পাকিস্তানই তো পরে বাংলাদেশ হলো এবং স্মরণ করা যেতে পারে যে, কবি আবদুস সালাম ২৬ মার্চ ’৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোরান তেলাওয়াত করেন। কবি আবদুস সালামের ভাই আবদুর রউফ ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলি চালনার সংবাদ চট্টগ্রামে তিনিই প্রথম ছড়িয়ে দেন আন্দরকিল্লায় এক শ্রমিক সমাবেশে। তারপর সেই সংবাদ বিদ্যুৎ বেগে দাবাগ্নির মতো চট্টগ্রামে আনাচে কানাচে আগুন ঝরিয়েছিলো।
এর মধ্যে সম্ভবত চল্লিশের দশকের প্রারম্ভে ‘দেশপ্রিয়’ নামে আরো একটি উল্লেখযোগ্য অগ্নিবর্ষী রাজনৈতিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। সম্ভবত দেশপ্রিয় জেএম সেনগুপ্তই পত্রিকাটি প্রকাশিত করেছিলেন।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর ভারত থেকে কয়েকজন বিখ্যাত মোহাজের সাংবাদিক এসে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতকে সমৃদ্ধ করলেন। এদেরই উদ্যোগে ‘ইস্টার্ন এক্সামিনার’, ‘ক্রনিকল’, ‘ইউনিটি’ ইত্যাদি প্রকাশিত হলো; অন্যদিকে সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম ‘জমানা’ ও ফজলুল কাদের চৌধুরী ‘আজান’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন। তবে ‘সীমান্ত’ নামে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা প্রকাশ করলেন সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরী। চৌধুরী হারুনুর রশিদ ‘আওয়াজ’ নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেছিলেন। রুহুল আমিন নিজামী সিনে মাসিক ‘উদয়ন’ এবং ফররোখ আহমদ নিজামপুরী ও লোকমান খান শেরওয়ানীও হয়তো কোনো পত্রিকা প্রকাশ করে থাকবেন। মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত। অবশ্য তারও আগে ইসলামাবাদী সাহেব প্রকাশ করেছিলেন ‘ছোলতান’।
এসে গেল ষাটের দশক। অতঃপর আজাদীর ইতিহাস। শুরু থেকেই আজাদী সংবাদের আনুকূল্য পেয়ে এসেছে। কোনো কোনো পত্রিকা এবং কোনো কোনো সাংবাদিক, যাঁদেরকে বলা যায় সংবাদের বরপুত্র। আজাদী প্রকাশের সময় পাকিস্তানে প্রচণ্ড ঝড়–তুফান হয়েছিলো। বার্তা সম্পাদক ছিলেন হাবিবুর রহমান খান। তখন তো টেলিপ্রিন্টার–টরে টক্কার যুগ। রেডিও’র সাপোর্টও তখন সম্ভবত কিছু কিছু পাওয়া শুরু হয়েছে। হাবিবুর রহমান খান প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরটা কাঠের টাইপের বড় বড় হরফে ফলাও করে প্রকাশ করলেন। আজাদী প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে ফেললো। সেই যে শুরু হলো আজাদীর সংবাদের জয়যাত্রা, আজো তা অব্যাহত অপ্রতিহত গতিতে।
ছাপ্পান্ন বছরের পথচলা কি শুধুই মসৃণ? যাত্রাপথে কি শুধুই পুষ্পবিছানো ছিলো? কোনো কাঁটা উঁচিয়ে ছিলো না পথে? কোনো বাধা, বিঘ্ন, বৈরিতার সম্মুখীন হতে হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। হয়নি বললে মিথ্যা বলা হবে। বন্ধু ছিলো শত শত, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ; শত্রুরও কিন্তু একেবারে অভাব ছিলো না। হয়তো সংখ্যায় নগণ্য। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার লোকের অভাব কোনোকালে হয় না। তবুও আজাদী শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে অজস্র, অগণিত পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত হতে হতে সমৃদ্ধ আগামীর পথে এগিয়ে গেছে। প্রত্যেক পেশাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে, স্বাস্থ্যকর, সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে। আজাদীরও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব হয়নি। বিভিন্ন সময়ে আজাদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছে ‘স্বাধীনতা’, ‘দেশবাংলা’, ‘নয়া বাংলা’; কিন্তু আজাদী কখনো বিচলিত হয়নি, লক্ষ্যচ্যুত হয়নি; অবিচালিত যাত্রাপথে এগিয়ে গেছে সমুখ পানে স্থির, অচঞ্চল। প্রতিযোগিতা হয়েছে আনন্দময়।
৬৫ বছরের ইতিহাসে আজাদীর সবচেয়ে বড় অর্জন কী? অবশ্যই টিকে থাকা এবং শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পারা। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে নানা সময়ে নানা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, কোনো কোনো পত্রিকা রীতিমত হৈ হুল্লোড় ফেলে দিয়ে সকল পত্রিকাকে ছাড়িয়ে গিয়ে প্রচার সংখ্যার পূর্ববতী রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিছুদিন, হয়তো কয়েক বছর কিংবা যুগও হতে পারে এই ধুমধাড়াক্কার কাগজ পাঠকচিত্তে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি ও প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে হুজুগ কেটে গেলে পড়ে থাকে তলানি। যেমন বেনোজলের স্ফীতি হ্রাস পেতে পেতে জেগে থাকে কাদামাটি। ব্রিটিশ জমানার কলকাতার যুগ থেকে উদাহরণ নিলে দেখা যাবে এক সময়ের বহুল প্রচারিত পত্রিকা আজাদ, শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তির করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। পাকিস্তানি জমানার ঢাকা অধ্যায়ের ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজারভার, পূর্বদেশ ইত্যাদি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঠক তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইত্তেফাক আশির দশক পর্যন্ত শীর্ষ স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও এরপর থেকে পাঠকপ্রিয়তা হারাতে থাকে। আজাদ এর জনপ্রিয়তা স্বাধীনতার পূর্বেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। পূর্বদেশ স্বাধীনতার পরেও কিছুদিন, সংবাদ অনেকদিন কাটতি ধরে রেখে এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যদিও সংবাদ এখনো প্রকাশিত হয়। পূর্বদেশ এখন নতুন ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ‘গণকণ্ঠ’, ‘খবর’, ‘আজকের কাগজ’ এবং ‘ভোরের কাগজ’ এই চারটি কাগজ পাঠকের কৌতূহল জাগ্রত রেখে এক একটি পত্রিকা এক একভাবে করুণ পরিণতি বরণ করে।
তাহলে দেখা গেল ওপার বাংলায় আনন্দবাজার এবং এপার বাংলায় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী ছাড়া আর কোনো পত্রিকাই হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে পারেনি। ইত্তেফাক, সংবাদও অর্ধশত বছর অতিক্রম করেছে, কিন্তু স্বর্গচ্যুত হয়ে। পাঠকের প্রশংসায় তাদের ভরা যৌবন এখন বার্ধক্যের ভারে জবু থবু, ন্যুব্জ, নমিত। আজাদীর শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে, ৬৫ বছর বয়সেও তার ভরা যৌবন দুকূল উপচে পড়ছে। বয়সের ভারে এতটুকু ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই। বরং সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ পরিবেশনের নব নব কৌশলে, তির্যক মন্তব্যে, রূঢ় কঠিন ভাষ্যে, অপ্রিয় সত্যের উদঘাটনে, স্কুপ–এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন রচনার নৈপুণ্যে আজাদী নিজেকে নিজে ছাপিয়ে যায়। আমাদের বিস্ময় পরাভব মানে, ঘোর কাটতে চায় না; আবিষ্কারের পুলকে শিহরণ জাগে, এই আজাদীর কোনো তুলনা হয় না। কী কৌশলে আজাদীর ভরা যৌবন অটুট, অবিচল, অবিকল! ধন্দ্ব লাগে। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীকে স্মরণ করতে ইচ্ছা হয় যেখানে তিনি বলছেন অতিকায় ডাইনোসর লোপ পেয়েছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে। কীভাবে? ডারউইন সাহেবই এর যথার্থ উত্তর দিয়েছেন–সারভাইভাল ফর দি ফিটেস্ট। যোগ্যতমেরই টিকিয়া থাকিবার অধিকার আছে। জলবায়ু, প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে যে প্রাণী খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেই প্রাণীটি লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনের ধাপে ও চাপে বেঁচে বর্তে থাকে।
সংবাদপত্রে কেউ ডাইনোসর নয়, কেউ তেলাপোকাও নয়। তবুও যুগের চাহিদা, নব প্রজন্মের পাঠকের রুচি, ভাষার বিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবার সক্ষমতার ওপরই কোনো পত্রিকা তেলাপোকার মতো টিকে থাকে। যেমন আনন্দবাজার, আজাদী। আজাদী যে কারণে শীর্ষস্থান অক্ষুণ্ন রেখে টিকে আছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, আমার বুঝ হলো আজাদী বরাবর চট্টগ্রামের পত্রিকাই থাকতে চেয়েছে। জাতীয় পত্রিকা বা আন্তর্জাতিক মান অর্জনের মোহ আজাদীর কোনোকালে ছিলো না। আজাদীর মালিকের ভাবনাটা মনে হয় এরকম, আমি অনুমান করি–আমার পত্রিকা তো আর কখনো শুভপুরের ওদিকে যাবে না [কথাটা মহিউদ্দিন চৌধুরীও বলেন) সুতরাং কাকের ময়ুরপুচ্ছ ধারণ করে কী লাভ। তাই আমার ধারণা মালেক সাহেব শুভপুর থেকে টেকনাফ–বৃহত্তর চট্টগ্রামের যে ভুগোল, তার যে মাপ এবং মান– সে মত একটি পত্রিকাই করতে চেয়েছেন। অতএব আজাদী মানে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম মানে আজাদী–ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়ে গেল। খাস চট্টগ্রামের একটি পত্রিকা হয়ে গেল আজাদী। হাতে হাতে প্রমাণও পেয়ে যাচ্ছি–বিদেশে প্রবাসী চট্টগ্রামের কোনো মানুষ তাঁর কোনো নিউজ দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়লে তিনি আগে আজাদী পত্রিকারই খবর নেন। সে শোক সংবাদ হোক বা নিরুদ্দেশ সংবাদ হোক কিংবা আনন্দ সংবাদ বা অ্যালামনাই জাতীয় খবর–প্রথমেই তাঁর চোখে আজাদীর ছবিটা ভেসে ওঠে এ আমি নির্ঘাত বলে দিতে পারি। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও তাই। আনন্দবাজার যেমন শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন ছাপানোর জন্য আলাদা পাতা বের করে–আজাদীতেও মাঝে মাঝে ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপনে পৃষ্ঠা ভরে যায়।
আর একটা বিষয়। শহরে কোনো নতুন বালা মুসিবত বা উপদ্রব দেখা দিলে সে সংবাদ সবাই প্রকাশ করে। কিন্তু আজাদীর সাংবাদিকদের চাটগাঁইয়া মস্তিষ্কে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সেই বালা মুসিবতের একটা নামকরণ হয়ে যায়। আমার যতদূর মনে পড়ে শহরে হঠাৎ হাইজ্যাক ছিনতাই বেড়ে গেলে সবাই হাইজ্যাক, ছিনতাই ইত্যাদি শব্দে হেডলাইন দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল আজাদী লিখলো ‘ঝাপটা পার্টি’–এ একেবারে নতুন। এমন যুতসই এবং চট করে মানুষের মর্মে গেঁথে যাওয়ার মতো শব্দ আর হয় না। এমনি আরো কত চাটগাঁইয়া হেডিং যে আজাদী দিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে টানা পার্টি, লাগেজ পার্টি।
একবার নির্বাচনী প্রচারণায় জোরে শোরে টাকার খেলা শুরু হয়ে গেলে ওসমানুল হকের রসবোধ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তিনি লিখলেন রসিয়ে রসিয়ে এবং এমন একটা হেডিং দিলেন সবাইতো তাজ্জব, লা জবাব– “বোঁদা বোঁদা টেঁয়া ওড়ে।”
মালেক সাহেব বেশ কিছুদিন ‘যা দেখেছি যা শুনেছি’ শিরোনামে সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’ গোছের একটা লেখা শুরু করলেন। তাকে কী কলাম বলবো না রিপোর্টাজ–আমি এখনো ভেবে উঠতে পারিনি। তিনি কেন লেখাটা কনটিনিউ করলেন না, আমার বুঝে আসেনি। কিন্তু দেখা এবং শোনার ছলে সমাজের নানা অসঙ্গতি, অনিয়ম, কখনো বা ঘুষ–বখশিসকে তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপের খোঁচায় ক্ষত বিক্ষত করে প্রতিদিন পরিবেশন করতেন আজাদীর পাতায়, তাতে যিনি মালেক সাহেবের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, আমার মনে লয় তিনি গোস্বা করতেন না। ওসমানুল হকের ‘বোঁদা বোঁদা টেঁয়া ওড়ের ধরি ল’ পড়ে আমার মনে পড়ে গিয়েছিলো সাহিত্যিক বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসের কথা। ওসমানের তুলনাটা আশ্চর্যজনকভাবে মিলে গিয়েছিলো বিমল মিত্রের কথার সঙ্গে যেখানে তিনি লিখে গেছেন–যুদ্ধের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) বাজারে কলকাতার আকাশে নাকি টাকা উড়তো।
পতেঙ্গা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে চোখ আটকে গেল একটা বিশালাকার বিলবোর্ডে ‘আইয়ন যে’। আহা! কী মধুর চাটগাঁইয়া সম্ভাষণ। এর চেয়ে মোহন–মোলায়েম কিছু আমার জ্ঞানে আসছে না।
আমার কথা ফুরাল, কিন্তু নটে গাছটি মুড়লো না। কেননা সুসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় পড়েছি, প্রিয়ার যৌবন, রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা। আমরা এতক্ষণের আলোচনায় দেখলাম, পত্রিকার জন্ম হয়, মৃত্যুও হয়। কিন্তু আজাদীর মৃত্যু হয় না, কারণ আজাদী অবিনাশী।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক।