১লা অক্টোবর, আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস–২০২৩। পৃথিবীর সব দেশের মত আমাদের বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে দিবসটি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে: ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ব্যক্ত অধীকার অনুযায়ী প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা’। প্রজন্ম থেকে দায়বদ্ধতা আমাদের দেশে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে প্রবীণ বলে গণ্য করা হয়। প্রবীণ কারা? জাতিসংঘের মতে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের ষাট বছরের বেশি বয়সীরা প্রবীণ। উন্নত দেশ গুলিতে পঁয়ষট্টি বছরের অধিক বয়সীরা প্রবীণ। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ প্রবীণ। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি পাঁচ জনে একজন মানুষ প্রবীণ হবেন। আর আমরা বেঁচে থাকলে বার্ধক্যকে অবশ্যই বরণ করতে হবে।
প্রবীণের চাহিদা কী? ভালো বিছানা, সুস্বাদু খাবার, পরিষ্কার কাপড় চোপড়, চিকিৎসা সেবা, নিয়মিত ঔষধ পত্র, যত্ন আত্তি পাওয়া, আত্মীয় স্বজনকে দেখা, মর্যাদা সম্মান পাওয়া, যে কোনো বিষয়ে মতামত দেয়া, ধর্মকর্ম করা, বেড়াতে যাওয়া, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যাওয়া ইত্যাদি।
প্রবীণের সংকট কী? প্রথমত প্রবীণের শারীরিক সংকট। যেমন চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, সারা শরীরে ব্যথা, উচ্চ রক্ত চাপ, প্রস্রাবের সমস্যা– ডায়াবেটিস, বাতের ব্যথা, মাথা ঘোরা–ঝিম ঝিম করা, শরীরে চুলকানি, শরীর খসখসে হওয়া, ঘনঘন পড়ে যাওয়া, কোষ্ঠ কাঠিন্য, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, রক্তে চর্বি বেড়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া, খাবারে রুচি না থাকা, পেট ফাঁপা, বুকজ্বালা ইত্যাদি। প্রবীণরা গড়ে পাঁচটি রোগ বহন করে। কারো কারো আরও বেশি রোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, প্রবীণের মানসিক সংকট, আর্থিক সামর্থ্য না থাকা, সমাজে পরিবারে গুরুত্ব না পাওয়া, রাগ বেড়ে যাওয়া, নালিশ করার প্রবণতা, একাকীত্ব, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন– কথা বেশি বলা, নিজকে পরিবারের বোঝা মনে করা, পরিবারের সদস্য কর্তৃক অপমান, অবহেলা, গালাগালি ইত্যাদি। প্রবীণ নিজে মানতে চায় না তাঁর শারীরিক বয়স হয়েছে। বয়সের কারণে তাঁর নানা ধরনের রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। প্রবীণ বলবে, ‘আগে আমার কোনো রোগ ছিল না, আমি ভালোই ছিলাম। তবে এখন কেন আমার এমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে!’
প্রবীণের সম্ভাবনা কী? প্রবীণ মাত্রই সব কিছু শেষ তা নয়। দীর্ঘ জীবনে প্রবীণ নানা সংকট মোকাবেলা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। জীবনে সাফল্য যেমন লাভ করেছেন তেমনি ব্যর্থতা রয়েছে অনেক। জীবন থকে প্রবীণ অনেক কিছু শিখেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক বড়। তাঁর মতামত পরামর্শ অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। প্রবীণরা দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকেন না। জীবনের শেষ পর্যায়ে সবাই ভালো কাজ করতে চায়, মানুষের কাছ থকে স্বীকৃতি পেতে চায়। বেশির ভাগ প্রবীণই সৎ, নির্ভরযোগ্য, আদর্শবান হয়ে থাকেন। প্রবীণের যুক্তি নবীনের শক্তি! যা সমাজকে এগিয়ে নিতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
প্রবীণ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সর্ব প্রথম যে সত্যটি চোখের সামনে প্রতিভাত হয় তা হল বার্ধক্য, জরা এবং অসহায়ত্ব। বার্ধক্যকে কেউ এড়িয়ে চলতে পারবে না। বার্ধক্যের স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতেই হবে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন কিছুটা শক্ত অবস্থানে থাকলেও অর্থনৈতিক কারণে কখনও কখনও পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা দেখা যায়।
আজকের নবীন আগামী দিনের প্রবীণ উক্তিটা উল্টো করে বললে দাঁড়ায়, আজকের প্রবীণ বিগত দিনের নবীন। অর্থাৎ যারা আজ প্রবীণ, তাঁরাও এক সময় তারুণ্য ও যৌবনের উদ্দীপনায় উদ্বেলিত ছিল। সময়ের ব্যবধানে মানুষ পৌঢ়ত্ব বরণ করে নেয়, এটাই সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম।
প্রবীণ জনগোষ্ঠী এ সমাজ ও জাতিরই অংশ। আজকের প্রবীণ লোকটিই একদিন তাঁর সমস্ত শক্তি সামর্থ দিয়ে দেশের এবং পরিবারের চাহিদা মেটাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সুতরাং বার্ধক্যে উপনীত হয়ে তিনি যখন সকল কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ভেতর একটা হতাশা কাজ করে। এ সময় একটু সহানুভূতি, মমত্ববোধ হয়তো তাঁকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দিতে পারে।
কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণদের জন্য পৃথক করে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়নি, কারণ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনযায়ী বড়দের সর্বদা সম্মান ও দেখাশুনা করার স্বাভাবিক নিয়ম প্রতিটি পরিবারে পরিলক্ষিত হত। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে পারিবারিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে ভূমি সংকট, বাসস্থান সংকট, জীবিকার তাগিদে পরিবারের সদস্যদের নগরমুখী অবস্থান প্রভৃতি অন্যতম।
বাস্তবতার নিরিখে অসহায় বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় বৃদ্ধাশ্রম প্রয়োজন সেটা যেমন সত্য, সে সাথে এটাও বেদনাদায়ক যে, সন্তান–সন্তুতি সব থাকার পরও একদিন যে মা–বাবা নিজেদের সবকিছু দিযে সন্তান মানুষ করেছেন সে সন্তান যখন মা–বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, তার মত দুর্ভাগা আর কে হতে পারে! বৃদ্ধ মা–বাবাকে বোঝা নয় বরং সৃষ্টিকর্তার পরম আশীর্বাদ মনে করতে হবে। বৃদ্ধ মা–বাবাকে নিজের সাথে রাখলেও কেউ যেন গর্ব করে এই কথটা না বলে যে, ‘আমার মা–বাবা আমার সাথে থাকেন’ বরং বলা উচিত যে, ‘আমি আমার মা–বাবার সাথে থাকি’। এটিই নতুন প্রজন্মের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
আজকের নতুন প্রজন্ম আগামীর প্রবীণ, তাদের মধ্যে নিজের দাদা–দাদি, নানা–নানি, মা–বাবা, চাচা–চাচী, মামা–মামী, ফুফা–ফুফি, খালা–খালু এ সব সম্পর্কের মর্যাদা সৃষ্টি করতে হবে। শুধু রক্তের সম্পর্কের কথা বললেই চলবে না, এছাড়াও ওস্তাদ–গুরু, শিক্ষক শিক্ষিকা সহ সমাজের বিভিন্ন পেশার বড়জনদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান করতে হবে। তাঁদের ভালো মন্দ খবরাখবর নিতে হবে। এই কাজটি প্রতিটি পরিবারের সকল সদস্য কে দায়িত্বের সাথে করতে হবে এবং এই প্রজন্মকে আমাদের এমনভাবে তৈরী করতে হবে যাতে পরবর্তীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ধারা অব্যাহত থাকে।
আর যদি এমনটি হয় তাহলে আর কোনোদিন কোনো প্রবীণকে অবহেলিত হতে হবে না, বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া লাগবে না। আমরা পাবো একটি সুন্দর মার্জিত স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখা।