আজ ছাব্বিশে মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের এক মহান দিন। এই দিনটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক দুঃখ–কষ্ট–বেদনা, রয়েছে অনেক উচ্ছ্বাস, আবেগ, অনুভূতি আর আনন্দবেদনার মিশ্রণ।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। যে যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেকেই। অনেকেই হারিয়েছেন তাঁদের মূল্যবান সহায়–সম্পদ। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বাঙালির ওপরে যে অত্যাচার করেছিল, তা বর্ণনাতীত। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষার বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল নতুন রাষ্ট্র, নতুন মানচিত্র ‘বাংলাদেশ’। তাই ১৯৭১ সাল বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
অনেক ত্যাগ, অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্তের বিনিময়ে এসেছে এ স্বাধীনতা। সেজন্য এদেশের বীর যোদ্ধা যারা দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সেই বীর সূর্য সৈনিকদের জানাই অজস্র সালাম আর শ্রদ্ধা। আমরা শ্রদ্ধা জানাই স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সব সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাকে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দৃপ্ত শপথের দিন আজ।
বলা জরুরি যে, বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাকার। একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বঙ্গবন্ধু তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে পরিণত করেছিলেন নিজের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে। অসীম সাহস, মনোবল, ত্যাগ ও নেতৃত্বগুণে তিনি জাতিকে এক করতে পেরেছিলেন। তিনি যেমন চেয়েছিলেন তাঁর বাঙালি জাতি যেন বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তেমনি চেয়েছিলেন গরিব–দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। নিজের সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে তিনি তাঁর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করেছিলেন। ফলে বাঙালি পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এতে পূরণ হয় বঙ্গবন্ধুর সারা–জীবনের স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বুননের কারিগর। তাঁকে বলা হয় বাঙালি জাতির ধ্রুবতারা। বাঙালির সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা ও স্বপ্ন–আকাঙ্ক্ষাকে নিজের ভেতরে ধারণ করে তিনি বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন স্বাধীনতা। বিশ্বের বুকে এঁকে দিয়েছেন নতুন মানচিত্র। তিনি শুধু একটি স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। জাতি গঠনেও রেখে গেছেন অনন্য অবদান।
মহাকবি মিল্টন বলেছিলেন,‘স্বাধীনতা মানুষের প্রথম এবং মহান একটি অধিকার’। কিন্তু স্বাধীনতাকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করতে হলে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজের আবশ্যকতা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। স্বাধীনতার চেতনার একটি ছিল বৈষম্যের অবসান। তদানীন্তন শাসকচক্র আমাদের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করেছে শুরু থেকেই। তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, অবিচার, নির্যাতন–নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার ফলে আমরা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে একটা গণ–অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। এতে মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রম করা জাতীয় জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। আজ বাংলাদেশ সম্পর্কে সব নেতিবাচক এবং নিরাশাবাচক ভবিষ্যদ্বাণী অসার প্রমাণিত হয়েছে। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশকে যেখানে দারিদ্র্য আর অনুন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো, আজ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সেই বাংলাদেশকেই দারিদ্র্য জয় এবং উন্নয়নের আদর্শ মডেল হিসেবে তুলে ধরছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ৫৩ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষারপ্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চালু হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ। মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন হয়েছে। ধান, ফল, মাছ উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড লিগ টেবিল ২০২১ রিপোর্টে। রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ বছর পর বিশ্বের ১৯৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান হবে ২৫তম।
আজকের এই অর্জন এ দেশের সাধারণ মানুষের। আজকের এই দিনে দেশের আপামর জনসাধারণকে জানাই অভিনন্দন।