৬ই অক্টোবর বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। এই দিবসের উদ্দেশ্য হল সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বের উপর জোর দেওয়া, একই সাথে বিশ্বব্যাপী সিপি আক্রান্ত ব্যাক্তিদের শক্তি, ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরা। পাশাপাশি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো। এবারে বিশ্ব সেরেব্রাল পালসি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অনন্য এবং ঐক্যবদ্ধ’। এই প্রতিপাদ্যটি তুলে ধরে যে সিপি আক্রান্ত ব্যক্তিরা সকলেই অনন্য ব্যক্তি এবং একসাথে তারা পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর।
সিপি কী? সেরিব্রাল পালসিতে, সেরিব্রাল‘ মানে মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং ‘পালসি‘ মানে শরীরের দুর্বলতা ও কাপুনি। সেরিব্রাল পালসি হলো ব্যাধির ‘একটি গ্রুপ যা বিকাশমান মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণে সৃষ্ট স্থায়ী নড়াচড়ার অক্ষমতা এবং অঙ্গবিন্যাসজনিত শারীরিক অবস্থাকে বোঝায়। তীব্রতা এবং টোনের উপর ভিত্তি করে সেরিব্রাল পালসি কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন: স্পাস্টিক, ডিস্কাইনেটিক, অ্যাটাক্সিক এবং মিক্সড। একটি পরিসংক্ষাণে দেখা গেছে প্রতি ১,০০০ শিশুর মধ্যে সেরিব্রাল পালসিতে ২ থেকে ৪ জন আক্রান্ত হয়। বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৫ কোটি মানুষ সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত আর এ রোগে সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছেন প্রায় ৩৫ কোটি অভিভাবক, কেয়ারগিভার ও পরিবার–পরিজন। তবুও খুব কম মানুষ এটি সম্পর্কে সচেতন। সাধারণত গর্ভাবস্থায়, জন্মের সময় বা জন্মের পরপরই মস্তিষ্কের ক্ষতি বা অস্বাভাবিক মস্তিষ্কের বিকাশের ফলে সৃষ্ট স্নায়বিক অবস্থার ফলে এই রোগ হয়। এই রোগে দৃষ্টিশক্তি, বক্তৃতা এবং শেখার সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, মৃগীরোগ এবং মাংসপেশী নড়াচড়ার আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতি–সহ বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে। এটি মস্তিষ্ক ও পেশীর সমস্যাসহ অনেকসময় চোখ ও কানও সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়। সেরিব্রাল পালসি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয় । মানে এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায় না।
কারণসমূহ: এ জন্য দায়ী অনেক কারণ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে: গর্ভকালীন, জন্মের সময় ও জন্মের পরের বিভিন্ন জটিলতা। জন্মের পরপরই নবজাতকের কান্নাকাটি না করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে পরবর্তী সময়ে সেরিব্রাল পালসি হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মা রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস ভাইরাস, সিফিলিস, টক্সোপ্লাজমাসহ বিভিন্ন ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত হলে নবজাতক মস্তিষ্কের বিভিন্ন গঠনগত সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। নবজাতকের জন্ডিস যদি অতিরিক্ত হয় এবং তা যদি মস্তিষ্কে জমা হয়ে কারনিক্টেরাস নামের রোগে আক্রান্ত করে, তাহলে এ রোগ হতে পারে। বাচ্চা ভুমিষ্ঠের পরে মস্তিষ্কের সংক্রমণ। অপরিণত অবস্থায় ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুরও সেরিব্রাল পালসি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অসুস্থতা, ক্ষতিকর ওষুধ সেবন ও ধূমপানের অভ্যাস থেকেও শিশুর এমন রোগ হতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন?
সেরিব্রাল পালসির উপসর্গগুলো বিভিন্ন রকমের হতে পারে, এবং তা ব্যক্তি ও আক্রান্ত অংশ অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যা দেখে সেরিব্রাল পালসি শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। লক্ষণগুলো হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে । যেমনঃ ৩–৪ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও ঘাড় শক্ত না হওয়া, হাঁটতে ও বসতে অসুবিধা, কোনও কিছু ধরে রাখতে না পারা, পেশীর টোনের পরিবর্তন, কথা বলতে অসুবিধা, থাবার গিলতে অসুবিধা, মাত্রাতিরিক্ত লালারস নির্গত হওয়া, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা এমনকি মস্তিষ্কের ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
চিকিৎসা কী?
সেরিব্রাল পালসির নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে এ অবস্থায় আক্রান্ত শিশুদের জীবনমান উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায়, শিশুদের বিকাশগত অক্ষমতা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা তত বেশি। সমন্নিত চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে চলাফেরার সমস্যা কমানো যায়। সাধারণত উন্নত বিশ্বে অনেক স্পেশালিস্ট নিয়ে যেমন চাইল্ড নিউরোলজিস্ট, অর্থোপেডিক্স, সাইকিয়াট্রিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ডেন্টিস্ট, অকুপেশনাল ও স্পিচ থেরাপিষ্ট, অর্থোটিস্ট, পুষ্টিবিদ ও সমাজকর্মীসহ সবাই মিলে একটা টিম গঠন করে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজন ইতিবাচক মানসিকতা, স্বাস্থ্যসেবা, পুনর্বাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও প্রবেশযোগ্য পরিবেশ। সরকার–বেসরকারি উদ্যোগ ও সামাজিক সচেতনতাই পারে সবার জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করতে।
লেখক: ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইনচার্জ, ফিজিওথেরাপি বিভাগ, সিআরপি চট্টগ্রাম –এ.কে.থান কেন্দ্র।