পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর বাঁক ঘিরে এবং নদী তীরের অসংখ্য উঁচু–নিচু ও টিলা শ্রেণির পাহাড় বেষ্টিত অপরূপ লীলাভূমিতে অবস্থিত ‘নিভৃত–নিসর্গ’ পার্কটি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এটি বেদখল হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় পার্কের সকল কার্যক্রম। এখন ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ করে তাদের গড়ে তোলা বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিলে স্বরূপে ফিরতে শুরু করে পার্কটি। এতে ওই এলাকার মানুষেরা আবারও পার্ককে ঘিরে তাদের জীবন–জীবিকার উপায় খুঁজে পাবে, পাশাপাশি প্রকৃতি ফিরবে তার আপন মহিমায়।
আলোচিত এই পার্কটির অবস্থান কক্সবাজারের চকরিয়ার সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়নের সুরাজপুর মৌজায়। সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত প্রায় ১০০ একরের মতো জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয় দৃষ্টিনন্দন এই পার্ক। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে শতবছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুন বাগান। এর সাথে যোগ রয়েছে পাহাড়–নদী–ছড়ার অপরূপ মিতালী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৪ এর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপর দৃষ্টিনন্দন এই পার্কটির ওপরও নেমে আসে অরাজকতা। হঠাৎ একদল ভূমিদস্যু এই পার্কটির ওপর হামলে পড়ে। তারা মুহূর্তের মধ্যেই পার্কজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব ও লুটতরাজ চালিয়ে একেবারে পাল্টে ফেলে পুরো চেহারা। কক্সবাজার জেলা ও চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক পার্কের পরতে পরতে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেয়। তারা রাতারাতি প্লট আকারে ভাগ–বাটোয়ারা করে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় পার্কের পুরো জায়গা। মূলত এর পর থেকেই একেবারেই বন্ধ হয়ে পড়ে এই পার্কের সকল কার্যক্রম।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলে টনক নড়ে জেলা প্রশাসনের। অবশেষে সেই নিভৃত–নিসর্গ পার্কের পুরো জায়গা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে ভূমিদস্যুদল কর্তৃক অবৈধভাবে গড়ে তোলা বিভিন্ন স্থাপনা। এরপর সেখানে ফের শুরু করা হয়েছে পার্কের কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন করে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম। এতে স্বস্তি ফিরে পায় ভ্রমণপিপাসু দেশি–বিদেশি পর্যটক–দর্শনার্থী ছাড়াও স্থানীয় জনসাধারণ।
১০০ একরের এই খাস জায়গায় ২০২০ সালের পর চকরিয়ার নতুন পর্যটন স্পট হিসেবে ‘নিভৃত–নিসর্গ’ নামকরণের পর পার্কটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর কোলঘেঁষে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যমন্ডিত নতুন পর্যটন স্পট দুপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা নদীপথ বয়ে গেছে। নৌকাভ্রমণে কিছুদূর গেলেই চোখে পড়বে শ্বেতপাথরের বিশাল পাহাড়। পর্যটন কেন্দ্রটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন ইকো পার্ক, বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ বাগান, কায়াকিং বোট (নৌকা) ও বিভিন্ন ধরনের নৌকার মাধ্যমে নৌ ভ্রমণ সুবিধা, পিকনিক স্পট, ক্যাম্প ফায়ার, তাবুতে রাত্রী যাপনসহ আরো বেশ কিছু রোমাঞ্চকর ইভেন্ট নিয়ে নদী ও পাহাড় বিস্তৃত আধুনিক মানের একটি পর্যটন কেন্দ্র চালু করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে স্থানীয় জনগণ এবং রাখাইন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর পরিবারে ফিরে আসে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা।
চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি মাহমুদুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, সরকারের ১ নম্বর খাসখতিয়ানভুক্ত প্রায় ১০০ একরের বিশাল এই জায়গাটি প্রাকৃতিকভাবে একেবারে মিনি কাশ্মীরের মতোই নয়নাভিরাম এবং সাজানো–গোছানো। কিন্তু বহু বছর ধরে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের কবজায় থাকা এই জায়গা জেলা প্রশাসন পুনরুদ্ধারের পর সেখানে নিভৃত–নিসর্গ পাকটি গড়ে তোলা হয়। এতে দেশি–বিদেশি এবং এতদঞ্চলের ভ্রমণপিপাসু পর্যটক–দর্শনার্থীদের কাছে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের স্পট হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ভূমিদস্যু কর্তৃক দখলে নেওয়ার পর থেকে একেবারেই স্থবির ছিল পার্কের কার্যক্রম। সেই সরকারি জায়গা ফের উদ্ধারসহ পার্কটিকে পূর্বের রূপে ফিরিয়ে নিতে প্রশাসনের নেওয়া উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
দৃষ্টিনন্দন পার্কটিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, চকরিয়ার এই পর্যটন স্পটটির পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং পাহাড়ের নিচ দিয়ে প্রবহমান মাতামুহুরী নদীর নীল জলরাশি গোধূলি বেলায় ভ্রমণপিপাসুদের বেশ নজর কাড়ে। তাই পাহাড়–নদীর অপরূপ মহিমায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে এখানে অগুনিত পর্যটক–দর্শনার্থী ভিড় করে প্রতিনিয়ত। ইউএনও বলেন, পার্কটিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। এরই অংশ হিসেবে দখলদারদের কাছ থেকে পুরো পার্কের জায়গা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে। এখন সেখানে চলছে গেইট নির্মাণসহ অবকাঠামোগত নানাবিধ উন্নয়ন। চলছে বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন স্থাপনের কাজও। উন্নয়নমূলক এই কাজ শেষ হলেই পর্যায়ক্রমে পার্কের সার্বিক কার্যক্রম তথা পর্যটক–দর্শনার্থীরা এই পার্ক ভ্রমণ করতে পারবেন।