আগামীকাল শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার রাজপথে আন্দোলনরত অবস্থায় জিরো পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা জেলা আওয়ামী মটর চালক লীগের প্রচার সম্পাদক নুর হোসেন। জন্ম তারিখ ১৯৬১ সালে ফিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া গ্রামে। ২৬ বছর বয়সের এই টগবগে যুবক সেদিন রাজপথে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজের বুকে পিঠে স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক স্লোগান লিখে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পিতা মুজিবুর রহমান, মাতা মরিয়ম বিবি পুত্র শোকে সুহ্যমান। ’৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা সপরিবারে ঢাকায় নারিন্দার বনগ্রাম রোডে আসেন। সেখানে তার শৈশবকাল কেটেছে পিতা ছিলেন একজন অটো রিকশা চালক। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বেশি দূর লেখা পড়া করতে পারেননি, মাত্র ৮ম শ্রেণী পাস করেছিলেন। ঢাকা জেলার আওয়ামী মটর চালক লীগের দায়িত্বে ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ১৯৮২ সালে একটি সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৬ সালে জালিয়াতি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। এর পর শুরু হল গণতন্ত্রের লড়াই এরশাদ বিরোধী যুগপথ আন্দোলনে আওয়ামীলীগ, বিএনপি সহ দেশের গণতান্ত্রিক সকল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো একীভূত হল। সেই আন্দোলন ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম সহ সমগ্র দেশ জুড়ে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল।
১৯৮৭ সালে মার্চ মাসে জাতীয় পার্টি সমর্থিত ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দীনের সাথে ঢাকায় ইস্কটন রোডস্থ হোটেল লর্ডস এর অভ্যর্থনা কক্ষে আমাদের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়। ঐসময় আইয়ুব আলী জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে হোটেলের একটি রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল। আমার সাথে রাশেদ, আলমগীর, হাসনী (সাবেক প্যানেল মেয়র) ছিল। ঐদিন বিকালে আমরা ফটিকছড়ি থেকে নির্বাাচিত সংসদ সদস্য নুরুল আলম চৌধুরীর সাথে তাঁর এমপি হোস্টেলে দেখা করি। তিনি আমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এর কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে আবারো জাতীয় ছাত্র সমাজের সাথে আমাদের সংঘাত হয়। শাহাদাত নামে একজন ছাত্রনেতাকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। চকবাজার ওলীখাঁ মসজীদের সামনে তাঁর লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। সে হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার হয়নি এমনকি থানায় মামলা পর্যন্ত নেয়নি একজন মন্ত্রীর নির্দেশে। জাতীয় পার্টির একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, যার বাড়ী চট্টগ্রামের উত্তর জেলায় তিনি অসংখ্য মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমাদের হয়রানি করেছেন। দীর্ঘদিন আমরা ঢাকায় অবস্থান করি।
১০ নভেম্বর নূর হোসেনের সাথে আরও দুইজন শহীদ হয়েছিলেন। একজন যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল অপরজন আমিনুল হুদা টিটু। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ বিরোধী দল ১১ ও ১২ নভেম্বর সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিলেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদ পদত্যাগ করলেন। ফলে স্বৈরচারের পতন ঘটে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। ঐ বছর ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসটিকে ঐতিহাসিক দিবস আখ্যায়িত করে সরকারিভাবে পালন করা হয়। কিন্তু ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর এ দল নূর হোসেন দিবসটি আর পালন করেনি। যে নূর হোসেনের রক্তের উপর ভর করে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি বা তাঁর দল কেন নূর হোসেন দিবস পালন করেন না এটা আজ জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ। এই দিবসটিকে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস হিসেবে তারা পালন করেন। বাংলাদেশের চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন, ১০ নভেম্বর আমরা যখন মিছিল শুরু করেছিলাম নূর হোসেন তখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে। আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তার গায়ে এ লেখা গুলোর কারণে তাকে পুলিশ গুলি করবে তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির কাছে এনে বলল, আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত। সরকার নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছেন। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও সরকার নূর হোসেন দিবসটি পালন করে আসছেন। যেখানে তিনি শহীদ হয়েছিলেন সেই জিরো পয়েন্টকে তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। নূর হোসেনের বুকে পিঠে লেখা আন্দোলনরত ছবিটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৮৮ সালে ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘির ময়দানে তৎকালীন বিরোধীদলীয়নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সমাবেশে স্বৈরশাসক এরশাদের নির্দেশে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার খুনি রকিবুল হুদার নির্দেশে পুলিশ পাখি শিকারের মত গুলি করে ২৪ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। অল্পের জন্য আমাদের প্রিয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পান। ৩৩তম শাহাদাত বার্ষিকীতে আমরা নূর হোসেন সহ সকল শহীদকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তিনি ছিলেন সামরিক স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনের এক ক্ষণজন্মা উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রতীক । এরশাদের অবৈধ ৯ বছর শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর মত শ্রমজীবী মেহনতী বিত্তহীন মানুষের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। তিনি নিজ উদ্যোগে মহল্লা বিত্তিক সংগঠন করে দলবেধে আন্দোলনে অংশ নিতেন। নূর হোসেন গাড়ি চালকের প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকা মিনি বাস সমিতি পরিচালিত বাসের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বুকে পিঠে লেখার জন্য মতিঝিল বিসিআইসি ভবনের পাশে ইকরাম হোসেনের সাইনবোর্ড লেখার দোকানে গিয়েছিলেন সেদিন। অনেক আকুতি মিনতির পরে স্লোগানটি লিখিয়ে নিয়েছিলেন। যদিও ইকরাম হোসেন সেটি লিখতে চাননি। কারণ স্লোগানটি ছিল সরকার বিরোধী। নূর হোসেনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ছেলের লাশ খুঁজতে বের হয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছিলেন। পাগলপ্রায় পিতা মাতা শেষ পর্যন্ত জুরাইন কবরস্থানে আসেন। সেখানে একজন বললেন একটা লাশ গায়ে পেইন্টারের রঙে বাংলা লেখা ছিল লাশ গোসলের সময় কেরোসিন তেল দিয়ে ঘসে ঘসে তা উঠানোর চেষ্টা করেও পারেনি। এভাবে শহীদ নূর হোসেনের কবরটি চিহ্নিত হয়। পুলিশ ঐদিন লাশ সরিয়ে ফেলে। ১৯৯০ সালে নতুনমাত্রা যোগ করে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ ) নেতা ড. শামশুল আলম খান মিলনের হত্যাকাণ্ডে চূড়ান্ত গণবিস্ফোরণের রূপ নেয়। আন্দোলনের মাত্রা যোগ হয় শেষ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর ১৯৯০ সচিবালয় থেকে কর্মকর্তাদের রাজপথে বেরহয়ে চিকিৎসকসহ জনতার মিছিলে যোগদান। তখন স্বৈরশাসক এরশাদ ঠিকতে না পেরে পরদিন ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
নূর হোসেন যেদিন মারা যায় আমরা সেদিন জিরো পয়েন্টে ছিলাম। চট্টগ্রাম দক্ষিণজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, ওয়াহিদুজ্জামান, বলরাম চক্রবর্তী, নজরুল ইসলাম সহ সেদিন অনেকের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। নূর হোসেনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে আজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদিতে বাংলাদেশের চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারলে শহীদ নূর হোসেনের আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক: শ্রম-সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণজেলা আওয়ামী লীগ