আগামীকাল ১৬ই অক্টোবর বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবস। ১৭৮তম এনেসথেসিয়া দিবসের থিম হচ্ছে, workforce wellbeing. বাংলা বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ‘কর্মশক্তি এবং সুস্থতা’। শারীরিক সুস্থতার মাধ্যমে কাজের উৎসাহ এবং ঊদ্যম নির্ভর করে। কর্মশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন উৎসাহ আর আনন্দ। অর্থাৎ প্রতিটি কাজের পেছনে আনন্দকে খুঁজে নিতে হবে। অবসাদ কাজের গতিকে পেছনে নিয়ে যায়। কোনোভাবেই অবসাদ কাম্য নয়। অবসাদ আর তাড়াহুড়া এনেসথেসিয়ার জটিলতা এবং মুত্যুর ঝুঁকি বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।
গত বছরের থিম ছিলো, সচেতনতাই এনেসথেসিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। প্রতি বছরের থিমগুলো এনেসথেসিয়ার উৎকর্ষ সাধন এবং আধুনিক ও নিরাপদ এনেসথেসিয়ার গুরুত্ব বহন করে। প্রতিটি অপারেশনে বিভিন্ন ধরনের এনেসথেসিয়ার প্রয়োজন হয় এবং একমাত্র এনেসথেটিস্টগণ এনেসথেসিয়ার এ গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়াও এনেসথেটিস্টগন আই.সি ইউ, এইচ.ডি.ইউ, ক্রিটিক্যাল কেয়ার এবং পেলিয়েটিভ কেয়ারের মতা বিষয়েও গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আই, সি, ইউ তে কর্মরত চিকিৎসকগণ নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এবং রোগীর লোকজন দ্বারা আক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন, নিগৃহীত ও শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হচ্ছেন। এটি কোনোভাবে কাম্য নয়। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা না দিলে কোনোভাবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব নয়। আই,সি,ইউতে শতকরা ৮০% রোগী মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে, যেহেতু এখানে সাধারণত ক্রিটিক্যাল রোগীগুলো ভর্তি হয়ে থাকে। ডাক্তাররাও অনেক স্ট্রেস-এর মধ্যে থাকেন। কাজেই নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনোভাবে সুষ্ঠু চিকিৎসা প্রদান সম্ভব নয়।
আধুনিক এনেসথেসিয়ার জনক স্যার ডব্লিও. টি. জি মর্টন। ১৮৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর এই আমিরিকান ডেনটিষ্ট রোগীকে ‘ইথার’ এনেসথেসিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে দিনটির শুভ সূচনা করেন।
দীর্ঘসময় পেরিয়ে এনেসথেসিয়া এখন অনেক আধুনিক। এর সাথে উন্নত মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিরাপদ এনেসথেসিয়া এখন হাতের নাগালে।
আমাদের দেশে আজকাল ওপেন হার্ট সার্জারী, এনজিওপ্লাস্টি, লিভার ও কিডনি ট্রান্সপেলেন্ট সার্জারীসহ আরো বড় ধরনের সার্জারী নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হচ্ছ। এসব নিঃসন্দেহে উন্নত ও নিরাপদ এনেসথেসিয়ার অবদান।
এনেসথেসিয়ার প্রকারভেদে রোগের প্রয়োজনে এবং রোগীর অন্যান্য শারীরিক সমস্যাজনিত কারণে এনেসথেসিয়ার বিপদের ঝুঁকিও বাড়ে। তাই এনেসথেসিয়ার পূর্বে অপারেশন জনিত রোগীর শারীরিক পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট ইনভেস্টিগেশান এবং অপারেশনের আগে রোগীর অন্যান্য রোগের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বিপদের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
যে সকল রোগ এনেসথেসিয়ার জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, তা হলো:
১. ফুসফুস জনিত সমস্যা
শ্বাস প্রশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ফুসফুস।
ফুসফুসের কার্যকারিতা ঠিক না থাকলে এনেসথেসিয়ার সমস্যা হতে পারে। এ্যাজমা, ব্রনকাইটিস, এমফাইসিমা, ফুসফুসে পানি বা বাতাস জমা, এছাড়াও কোনো প্রদাহ থাকলে জেনারেল এনেসথেসিয়াঅত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই এনেসথেসিয়ার পূর্বে রোগীর শ্বাস প্রশ্বাসের কার্যক্রম ঠিক আছে কিনা, তা নির্ধারিত এনেসথেটিস্ট দিয়ে চেক আপ করিয়ে নেয়া দরকার। ফুসফুসের কার্যক্রম ঠিক হলে পরবর্তীতে অপারেশনে যাওয়া শ্রেয়।
২. হৃদরোগ জনিত সমস্যা: হার্ট এবং ফুসফুস আমাদের জীবন ধারনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ। রোগীর উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের ইস্কেমিয়া বা অঙিজেন স্বল্পতা, ইনফারকশান, ধমনীতে ব্লক থাকা, হার্টে পানি আসা, হৃদরোগ জনিতকারনে ফুসফুসে পানি, হার্ট ফেইলিউর এবং হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া। এসব ক্ষেত্রে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। হার্টের কার্যক্ষমতার উন্নতি হলে পরবর্তীতে অপারেশনে এনেসথেসিয়ার বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে।
৩. কিডনি জনিত সমস্যা: কিডনি শরীরের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ, যা শরীরের দুষিত পদার্থগুলো নিঃসরণ করে। কিডনি জনিতরোগ যেমন:- নেফ্রাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রম এবং একুউড ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, কিডনিফেইলিউর যাদের আছে, তাদেরকে এনেসথেসিয়া দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ বটে।
৪. লিভার জনিত সমস্যা: লিভার হচ্ছে মানুষের এমন একটি অঙ্গ, যা গ্রহণকৃত খাদ্যদ্রব্যকে বিপাকে সাহায্য করে। লিভার জনিতরোগ যেমন:- হেপাটাইটিস, জন্ডিস, সিরোসিস ও লিভার ফেইলিউর ইত্যাদি। এসব রোগ প্রতিকার করার পরে এনেসথেসিয়া দেওয়া উত্তম।
৫. যাদের ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসঅপারেশনে এনেসথেসিয়ায় বিপদের ঝুঁকি বাড়ায় ও অপারেশান পরবর্তী ক্ষতস্থান শুকাতে বিলম্ব হয়।
৬. যাদের অনিয়ন্ত্রিত ইল্কট্রোলাইট রয়েছে, তাদেরও এটিকে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আনতে হবে, নয়তো এনেসথেসিয়ার রিকভারি হতে বিলম্ব হতে পারে অথবা রিকভারি নাও হতে পারে।
উল্লেখিত রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে এনেসথেসিয়া প্রদান করলে বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে।
প্রি-এনোসথেটিক চেক আপ: এটি এনেসথেসিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি করা হলে রোগীর এনেসথেসিয়ার জটিলতা অনেকাংশে কমে আসবে।
অপারেশনের ২৪ ঘণ্টা আগে রুটিন সার্জারীর বেলায় রোগীদের শারীরিক পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ইনভেস্টিগেশান দেখে রোগীকে এনেসথেসিয়ার ফিটনেস দেওয়া হয়। রোগীর অপারেশন কালীন সময়ে এনেসথেটিস্টগণ রোগীর পাশে বসে রোগীর নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ এনেসথেসিয়া নিশ্চিত করতে পারেন। ২০২২ ইং সালের বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবসের শ্লোগান ছিলো : Medication Safety. অর্থাৎ ওষুধ প্রয়োগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাড়াহুড়া, অমনযোগিতা ও অতি ব্যস্ততার কারণে ভুল ঔষধ প্রয়োগের সম্ভাবনা বহুলাংশে বেড়ে যায়।
নিরাপদ ও মানসম্মত এনেসথেসিয়ার মাধ্যমে রোগীর এনেসথেসিয়া প্রদান রোগীর জীবনের নিরাপত্তা ও মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।