আখেরাতের প্রস্তুতি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

পর্ব: আখেরাতবিশাল ও বিস্তৃত বিষয়। এর কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল। দুনিয়ার জীবনে অর্জন করা প্রতিটি কর্মের বিন্দু বিন্দু হিসাব দিতে হবে কাল কেয়ামতের মাঠে আল্লাহতায়ালার কাছে। যেমন: শাসক দ্বারা শাসিত এর উপর জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, হয়রানি, গুম, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, লুটতরাজ, বাকস্বাধীনতা হরণ প্রত্যেক বিষয়ের কড়ায় গন্ডায় হিসাব দিতে হবে মাবুদের কাছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলছেন, ‘একমাত্র সেইসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ আচরণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি’সূরা আশশূরা। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যারা অত্যাচার চালিয়েছে তারা অচিরেই জানতে পারবে তারা কি পরিণতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে’। তিনি আরও বলেন, ‘(হে নবী,) তুমি কখনো মনে কর না যে, এ জালেমরা যা কিছু করছে তা থেকে আল্লাহতায়ালা গাফেল রয়েছেন, তিনি তাদের এমন একটি দিন আসা পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে রাখছেন যেদিন চক্ষু স্থির হয়ে যাবে’সূরা ইব্রাহীম৪২। অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তারা নিজেদের কৃত অপকর্ম থেকে পরস্পরকে নিষেধ করত না। এটা ছিল তাদের জঘন্যতম আচরণ’সূরা আল মায়েদা। শাসক কর্তৃক শাসিত এর উপর জুলুম বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদেরকে ধোকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়’সহীহ্‌ মুসলিম। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, কেয়ামতের দিন জুলুম অন্ধকারে পরিণত হবে’সহীহ বুখারী। আজ পৃথিবীতে জুলুমবাজ শাসকের আবির্ভাব ঘটছে হু হু করে। তাদের মধ্যে মুসলিম শাসকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তারা জনগণের বাক স্বাধীনতা হরণ করে দিচ্ছে, হক কথা বলার স্বাধীনতা দিচ্ছে না। যারাই কোরআনের পক্ষে হক কথা বলার চেষ্টা করছে তাদেরকে কারাগারে বছরের পর বছর বন্দি করে রেখেছে। মিশরের শাসক মুসলিম হলেও অনেক বরেণ্য আলেমে দ্বীনকে আটক করে রেখেছে বছরের পর বছর। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে এবং কোরআনের রাজ কায়েম করতে গিয়ে মিশরের রাজপথ হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। মিশরের আল্‌ আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য অনেক শিক্ষাবিদকে একযোগে হত্যা করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর জালিম শাসকরা জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা অনেক স্বৈরশাসক ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। যেমন: লিবিয়া, মিশর, ইরাক ইত্যাদি। আখেরাতে আল্লাহতায়ালার কাছে যে জবাবদিহিতা করতে হয়, সেটা যদি আল্লাহর কোরআন হাদীসের জ্ঞানটুকু তাদের থাকতোতাহলে নিরীহ মানুষদের উপর তাদের অপশাসন অব্যাহত থাকত না। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে বিভিন্ন রাষ্ট্র কিংবা প্রদেশে পঠিয়েছেন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসাবে। সেই খোলাফায়ে রাশেদিনের স্বর্ণযুগ কি এখন ফিরে আসবে? হযরত মু’য়াজ ইবনে জাবল (রাঃ) কে ইয়েমেনের গভর্ণর হিসাবে প্রেরণ করার সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁকে বলেন, ‘সাবধান জনগণের মূল্যবান ধনসম্পদ রক্ষা করবে, আর মজলুমের দোয়া সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। কেননা আল্লাহ ও মজলুমের দোয়ার মাঝে কোন পর্দা থাকে না’। সহীহ বুখারী। সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন, তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহতায়ালা কথা বলবেন না, তাদের মধ্যে একজন হল মিথ্যাবাদী শাসক। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা নেতৃত্বের প্রতি লোভাতুর থাকবে অথচ নেতৃত্ব তোমাদের জন্য কেয়ামতের দিন অনুশোচনার কারণ হয়ে থাকবে’সহীহ বুখারী। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর কসম আমি এই দায়িত্ব কারও উপর অর্পণ করব না, যে তা চাইবে বা তার আকাঙ্ক্ষা করবেসহীহ বুখারী। রাসূল (সাঃ) বলেন, হে কাব ইবনে আযরা, আল্লাহ তোমাকে মূর্খ ও নির্বোধ লোকদের শাসন থেকে রক্ষা করুন। আমার পরে এমন শাসকরা ক্ষমতাসীন হবে, যারা আমার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করবে না– (আহমাদ)। রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিচারক হতে চায় অথবা সেই পদে নিয়োগ লাভ করে, অতপর তার অবিচারের চেয়ে সুবিচারের মাত্রা বেশি হয়, তার জন্য জান্নাত নির্দিষ্ট রয়েছে। আর যার সুবিচারের চেয়ে অবিচারের মাত্রা বেশি হয় তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত রয়েছে– (সুনানে আবু দাউদ)। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর শাসন আমলে এমন শাসক তিনি নিয়োগ দিয়েছেন যারা আল্লাহ এবং রাসূল (সাঃ) উপর বিশ্বাস রেখে এবং সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা সঠিক ভাবে দেখভাল করতেন এবং তাদের ন্যায্য অধিকারের দিকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। রাতের আঁধারে নাগরিকদের খোঁজ খবর নিতেন, সাধারণ নাগরিক সুবিচার পেতেন, আল্লাহর কোরআন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। সে যুগ এখন কি আছে? আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেই ওমর (রাঃ) এর যুগযিনি গভীর রাতে তাঁর প্রজাদের খবর নিতেন। দুঃখকষ্টের বোঝা নিজে বইতেন এবং অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। আজ সারা পৃথিবীতে অত্যাচারী শাসকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। যারা জনগণের অধিকারের চেয়ে নিজেদের অধিকার এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন বেশি। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, একজন শাসককে কেয়ামতের দিন জাহান্নামের পুলের উপর ছুঁড়ে মারা হবে। এর পরে পুলটি এত জোরে ঝাকুনি খাবে যে, তার জোড়গুলো খুলে স্থানচ্যূত হয়ে যাবে। ঐ শাসক যদি আল্লাহর অনুগত হয়, তাহলে এরপরেও সে ঐ পুল পার হয়ে যাবে। আর যদি সে আল্লাহর অবাধ্য হয় তবে তাকে নিয়ে পুলটি ভেঙ্গে পড়বে এবং সে ৫০ বছরের দূরত্বে অবস্থিত জাহান্নামের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। আমর ইবনু মুহাজির বলেন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ আমাকে বলেছিলেন, ‘যখন দেখবে আমি সত্যের পথ থেকে দূরে সরে গেছি, তৎক্ষণাৎ আমার কলার টেনে ধরে বলবে যে, ওহে ওমর তুমি এ কি করছো?’ অতএব হে জুলুমবাজ, অত্যাচারী শাসক! মনে রেখ, তোমার কারাগার হচ্ছে জাহান্নাম এবং মহাপ্রভু আল্লাহই তোমার চূড়ান্ত বিচারক। সেখানে তুমি কোন ওজর আপত্তি পেশ করতে পারবে না। ভয়াবহ কবর হবে তোমার হাজতখানা। আর দীর্ঘস্থায়ী হিসাবনিকাশ ও জবাবদিহির জন্য তোমাকে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং নিজেকে সেই শাস্তি থেকে বাঁচাও। আর ওহে মজলুম, মনে রেখ জালিমকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয় না।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন শিক্ষা ব্যবস্থাটা আমাদের আয়ত্তে আনাতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধমুহাম্মদ জামান হেডমাস্টার : অবিনশ্বর আলোকবর্তিকা