ইরানে ইসরায়েলি হানার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা আঘাত করেছে তেহরান। ইসরায়েলের সামরিক ও বিমান ঘাঁটিগুলোতে একযোগে এ হামলা চালানো হয়েছে। শুক্রবার রাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে তেল আবিবের দক্ষিণে। ওই হামলার নানা ভিডিও সমাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, তেল আবিবের ঠিক মাঝে আঘাত হানছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। ওই এলাকাতেই রয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দফতর। এছাড়া, আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দফতরও রয়েছে সেখানে। ১৯ সেকেন্ডের ওই ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’। কিন্তুআইরন ডোম সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেনি, তা ভেঙে আইডিএফ–এর সদর দফতরে আঘাত করে ক্ষেপণাস্ত্রটি। সঙ্গে সঙ্গে আলোর ঝলকানি এবং বিকট শব্দ।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের একটি উপশহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিস্ফোরণে ভেঙে পড়েছে বহু বাড়িঘর ও অফিস–আদালত, উল্টে গেছে শত শত গাছ।
বিবিসি লিখেছে, গত ২০ মাসের সংঘাতে কিছু অস্ত্রভাণ্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইরানের হাতে এখনও প্রায় ২ হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ধারণা। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এখন কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে আঘাত হানছে তারা। ইরানের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে তিনটি ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। অপর দুটির পাইলটকে জীবিত আটক করা হয়েছে। শুক্রবার ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে যে তিনটি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানো হয়েছে, প্রতিটিই এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান বলে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত ইরান সরকারি ভাবে একটি ইসরায়েলি বিমান ধ্বংসের কথা জানিয়েছে। ইরানি সেনা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইরানের পশ্চিম প্রান্তে একটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। ওই বিমানের পাইলটকে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে।
ইরান–ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, ইসরায়েল শুক্রবার ভোরে তার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানের ওপর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা শুরু করে। পরদিন দুপুরে তারা দ্বিতীয়বারের মতো হামলা শুরু করে। ইরান প্রথমদফা ইসরায়েলি হামলার পরই এর জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। এরপর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দুই দেশের মধ্যে সংঘাত কেবল বাড়ছে।
ইসরায়েল অঁটঘাট বেঁধে পরিকল্পনা করেই ইরানে হামলা চালানো শুরু করেছে সেটি স্পষ্ট। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সক্ষমতা পুরোপুরি নস্যাৎ করতেই ইসরায়েলের এই হামলা। কিন্তু ইসরায়েলে হামলা শুরু করে ইরান দেখিয়ে দিয়েছে তারা পাল্টা আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে। জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি বলেছেন, ইসরায়েলের হামলায় জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাসহ ৭৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে ৩২০ জন, যাদের বেশির ভাগ বেসামরিক ব্যক্তি। ইসরায়েলের দুই দফা হামলার জবাবে শুক্রবার রাতে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। তাতে ৪ ইসরায়েলির মৃত্যু হয়, আহত ৬৩ জন।
এদিকে ইরানের পাল্টা হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে সহায়তা করলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি ও জাহাজে আঘাত হানার হুমকি দিয়েছে তেহরান। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তেহরান সতর্ক করে বলেছে–এই তিন দেশ যদি ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘাঁটি ও যুদ্ধজাহাজগুলো ইরানের নিশানা হবে।
ইরানের হুমকির জবাবে কঠোর বার্তা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ত। তিনি বলেছেন, ‘ইরানের একনায়ক দেশের জনগণকে জিম্মি করে ফেলেছে। ইসরায়েলের বেসামরিকদের ওপর যে অপরাধমূলক হামলা চালানো হচ্ছে, তার জন্য তেহরানবাসীকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তেহরান জ্বলবে।’
যুদ্ধের আশঙ্কায় এর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ইরানের রাজধানী তেহরানে। বিবিসির সাংবাদিক রামিন মোস্তাকিম জানান, মানুষ চাল–ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুদ করতে দোকানে ভিড় করছে। বাজারের তাকগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। মানুষ বুঝতে পারছে না কী হতে যাচ্ছে। তাই যেটুকু পারছে, মজুদ করে নিচ্ছে। রাতভর বিস্ফোরণের শব্দে ঘুমহীন কাটছে মানুষের রাত। দিনে রাস্তাঘাট শুনশান, ক্যাফে ও দোকানগুলোতেও আগের মত ভিড় নেই।
এদিকে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পরই ইসরায়েলজুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে। সাইরেনের শব্দে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছোটেন। রিশন লে–জিওন শহরের বাসিন্দা ইফাত বেনহেইম বলেন, সাইরেন শোনার পর তারা ভবনের বেইসমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন। আমরা দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল, পুরো ভবন আমাদের ওপর ভেঙে পড়বে। এরপরই সব অন্ধকার হয়ে আসে।
হামলার পর সবাই বাইরে এসে দেখতে পান, আশপাশের বাড়িঘর সব ধ্বংস হয়ে গেছে; অনেক বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ে গেছে, রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঁচের টুকরো। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩০টি গাড়ি। ইফাত বলেন, দুই প্রতিবেশী ছিল; দেখা হলেই ভালো–মন্দ জিজ্ঞাসা করত; হামলায় দুজনই মারা গেছেন।
ইরান–যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা বাতিল : পাল্টাপাল্টি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের চলমান পরমাণু আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। ইরান ও দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্ততাকারী ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তী ধাপের আলোচনা এখন আর এগোবে না বলে বিবিসি ও আল জাজিরাকে নিশ্চিত করেছেন। আজ রোববার ওমানের রাজধানী মাস্কটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ষষ্ঠ দফার এ আলোচনা হওয়ার কথা ছিল।
তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অংশ হিসেবে চলছে এ আলোচনা। এর আগে রোমে পঞ্চম দফা পরমাণু আলোচনা হয়। তবে তাতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের হামলার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ও তার দল ইসরায়েলের ‘আসন্ন’ হামলা সম্বন্ধে জানতেন, তবে এরপরও তারা ইরানের সঙ্গে চুক্তির সুযোগ দেখছে।