আইনস্টাইনের দেশে

শঙ্কর প্রসাদ দে | শুক্রবার , ১৬ মে, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

জার্মানী দেখার প্রবল ইচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে তাড়িত করেছে কৈশোর থেকে। ৩টি কারনে তথা আর্যজাতি, হিটলার ও আইনস্টাইনের জন্মভূমি বলে এই কৌতুহল গ্রাস করেছে সময় পরিক্রমায়। ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখলাম, বেশীরভাগ পণ্ডিত মনে করেন উত্তর সাগরের শৈত্যপ্রবাহ জর্জরিত জার্মানীর মানুষ অপেক্ষাকৃত একটি সহনশীল আবহাওয়ার ভূখন্ড খুঁজছিল। সৌভাগ্যক্রমে বেশীরভাগ নাতিশীতোষ্ণ ঋতু বৈচিত্র্যের ভারতে শুরু হয় সাদা চামড়ার এক বিশাল জনগোষ্ঠীর অভিবাসন। বৌদ্ধ, খৃষ্ট এবং ইসলামের মতো শক্তিশালী ধর্মের তখনো আবির্ভাব হয়নি। আর্যদের আদিভূমি জার্মানী ও মধ্য এশিয়ায় ধর্ম বিশ্বাস বলে যা ছিল তাকে এক কথায় বলা যায় প্রকৃতি বন্দনা।

আর্য জনগোষ্ঠীর মূল প্রবণতাই ছিল খাদ্য ও পশুপালনের প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন। স্থান পরিবর্তন বা গমনশীলতার এই প্রবণতা থেকে ‘আর্য’ শব্দের উৎপত্তি। আর্যদের বিশাল একটি অংশ আজ থেকে মোটামুটি ৪/৫ হাজার বছর আগে বসতি গড়েছিল মধ্য এশিয়ায়। এরা স্থলপথে ভারতবর্ষের পথ আবিষ্কারের পর দলে দলে আসতে থাকে আজকের নদীবিধৌত পাঞ্জাব অঞ্চলে। এরপর যেখানে কর্ষণযোগ্য ভূমি পেয়েছে সেখানেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর্যরা আসার আগে থেকেই ভারতবর্ষে কৃষির অগ্রগতি হয়েছিল। অনার্য বা দ্রাবিড়রা তখন জীবন যাপনে বহুল পরিমাণে কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। সিন্ধু সভ্যতা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী থেকে বুঝা যাচ্ছে সনাতন ধর্ম তখন আদিম পর্যায় অতিক্রম করছিল। এজন্য একদল বিশেষজ্ঞের ধারণা আর্যদের আগমনের বক্তব্য সঠিক নয়। এ কথায় পরে আসছি। গবেষকদের বড় অংশ মনে করেন প্রথমে আজকের জার্মানী অতঃপর মধ্য এশিয়া থেকে আর্যরা ভারতে আসার পর শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে ভারতের সনাতন ধর্মীয় দর্শনগুলোকে গ্রহণ করে নিজেদের মতো করে। ভারতীয় দর্শন এবং ইউরোপীয় দর্শনের যুগলবন্দী হয়ে দেব দেবী অধ্যুষিত আজকের সনাতন ধর্মের বিকাশ ঘটে। তবে এটি অবশ্যই রামায়ন মহাভারত পরবর্তী সময়কাল। আর্যরা যে এসেছিল তার স্বপক্ষে জোড়ালো যুক্তি হল, এরা দ্রাবিড়দের সাথে বিবাহ সহ সামাজিক অন্যান্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। মহাভারত পড়লে বুঝা যায় ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সৃষ্টির কারিগর আর্যরা। বৈশ্য ও শুদ্রদের গায়ের রং দেখলেই বুঝা যায় এরা অনার্য বা দ্রাবিড়দের উত্তর পুরুষ। বেশীরভাগ বৈশ্য আর প্রায় শতভাগ শুদ্রদের গায়ের রং ইঙ্গিত করে এরা ভারতবর্ষের আদিবাসিন্দা।

অন্যদিকে আর্যরা যে এদেশের ভূমিপুত্র তার বড় প্রমাণের প্রথমটি সিন্ধুসভ্যতা। একটি অভিজাত শ্রেনী এসব নগর সভ্যতার শাসক ছিল। প্রত্ন নিদর্শনে মন্দির, মূর্তি সহ বহু ধরনের তৈজষপত্র থেকে বুঝা যাচ্ছে পূজার্চনার জন্য ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি এই ভূখন্ড থেকেই। বলা হচ্ছে কাশ্মীরের মতো ফর্সা মানুষ অধ্যুষিত এলাকা ভারতবর্ষে আরো অনেক ছিল। ঐসব মানুষগুলো পেশা হিসেবে পৌরহিত্যকে গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ শীতপ্রধান শ্বেতবর্ণের ভারতীয়রা একদল হয়েছে ব্রাহ্মণ আরেকদল ক্ষত্রিয়। আবার অনেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য সহ বিভিন্ন কারণে থিতু হয়। বিভিন্ন গোত্র ও পেশাজীবিদের সাথে এসব ফর্সা মানুষদের সামাজিকতা ও বিবাহ সম্পর্ক ক্রমশ; বেড়েই চলেছিল। এ কারনে বৈশ্যদের মধ্যে সংখ্যায় কম হলেও দীর্ঘ দৈহিক গঠন ও ফর্সা গায়ের রংয়ের এক অভিজাত শ্রেনীর অস্তিত্ব হয়েছে বিকশিত। আজকের সেনগুপ্ত দাশগুপ্ত উঁচু শ্রেনীর এই বৈশ্যদের সর্বশেষ উত্তরাধিকার। রামায়ন ও মহাভারত দু’টো পড়লে বুঝা যায় হিন্দুদের স্বর্গনরক হিমালয়ের অপর পাশে। সমুদ্র মন্থন মহাপাপ। শিবসহ অনেক দেবতার সাধনস্থল তুষার ধবল হিমালয় শৃঙ্গে। মহাভারত পর্বে আর্যরা এভূখন্ডে আসলে এসব আজগুবি অন্ধ বিশ্বাস জায়গা করার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং বলা যায় হিন্দুদের অভিজাত শ্রেনীর সৃষ্টি হয়েছে এই ভারতভূমি থেকে। সিন্ধু সভ্যতা পন্থীদের মতে আর্য বলে কোন জনগোষ্ঠী কথিত মতে ভারতবর্ষে আসেনি। তবুও আর্যদের আদি নিবাস জার্মানী দেখার সাধ তাড়িত করেছে হামবুর্গ পদার্পণ পর্যন্ত।

ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস এবং বিজ্ঞান তাড়িত করেছে নিরন্তর। জীবনভর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর পড়তে গিয়ে স্তম্ভিত হয়েছি এডলফ হিটলারের চিন্তা, ঔদ্ধত্য ও সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে। অষ্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত হিটলার শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তাকে সৈনিক জীবনে টেনে নিয়ে যায়। বীরত্বের জন্য দু’টো মেডেল প্রাপ্ত হলেও একরকম মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ, অতঃপর মিত্র শক্তি ইতিহাস খ্যাত ভার্সাইচুক্তি সম্পাদনে জার্মানীকে বাধ্য করে। ভার্সাই চুক্তি এতোই অপমানজনক ছিল যে মিত্র শক্তির অনুমোদন ছাড়া একটি বিমানও কেনা যাচ্ছিল না। হিটলার ওয়ারর্কার্স পার্টিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে বলতে লাগলেন এই অপমানজনক চুক্তি মানা যায় না। মধ্যপন্থী ওয়ার্কার্স পার্টি, ক্রমশ উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারায় প্রবাহিত হলো। হিটলার নেতৃত্বে উঠে আসার অব্যবহিত পরই দলটির নাম রাখা হল ‘নাৎসি পার্টি’। এর পরেরটা শুধুই ইতিহাস। ১৯৩৩ সালে নির্বাচিত ‘ফিউরার’ হয়েই ভার্সাই চুক্তি মানেন না বলে ঘোষণা দিলেন। তাঁর মতে নীল রক্তের জার্মানরাই একমাত্র এরিয়ান বা আর্য নৃগোষ্ঠী এবং পৃথিবীর সব’চে অভিজাত জনগোষ্ঠী। অবশিষ্ট পৃথিবী শাসনের অধিকার একমাত্র জার্মানদের। কট্টর ক্যাথলিক পন্থী হিটলার এও ঘোষণা করলেন জার্মান বা মানবজাতির প্রধানশত্রু ইহুদীরা। এরাই যীশুখৃষ্টকে ক্রশবিদ্ধ করার জন্য দায়ী।

হিটলারের আদর্শিক অবস্থানের সাথে কখনোই একমত ছিলাম না। তিনি জার্মানীর ক্ষমতা নিয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে জার্মান অর্থনীতিকে পরিণত করেছিলেন বিশ্বসেরা। সমরাস্ত্র ও বিমান উৎপাদনে টেক্কা দিয়েছিলেন বৃটেন ফ্রান্সকে। পৃথিবী শাসনের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ দখলে নিলেন পোল্যান্ড। এরপর ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিস্তীর্ন অঞ্চল পদানত করে হাত বাড়ালেন রাশিয়ার দিকে। এটিই ছিল হিটলারের সর্বশেষ মরনভুল। ধারণা করা হয় রাশিয়ার তীব্র শীতে দশলক্ষ জার্মান সৈন্যের বরফ মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রি: ইভাব্রাউনসহ হিটলার আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসে মহাবীর অর্জুন, আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়েনের কাহিনী পড়েছি। বীরত্বের জন্য ‘দি আলেকজান্ডার’ ‘দি নেপোলিয়েন’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। মাত্র ১২ বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রনায়ক হিটলার বীরত্বের যে কাহিনী সৃষ্টি করেছেন ‘দি হিটলার’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হওয়ার জোড়ালো যুক্তি থাকে। হামবুর্গ থেকে ফ্রাঙ্কফুট ওডার পর্যন্ত হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি বাস আর ট্রেনে। হিটলারের প্রিয় ‘‘রাইখস্ট্যাগ’ (সংসদ ভবন) এখনো দাড়িয়ে আছে। ভবনটি দেখে নয়ন ভরে দেখলাম আর ভাবলাম এই ভবন থেকে হিটলার বিশ্ব শাসনের ঔদ্বত্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন।

নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞানের শিক্ষক রাখাল স্যার ক্লাস লেকচারে প্রশ্ন করেছিলেন আলোর গতিপথ কেমন? বলেছিলাম, আলো সরল রেখায় চলে। স্যার বলেছেন নাআইনস্টাইনের মতে আলো অনেক সময় বেঁকে যায়। বড় হলে আলো কখন এবং কেন বেঁকে যায় তা বুঝতে পারবে। যতই বড় হয়েছি ততই আইনস্টাইনের ভক্ত হতে থাকলাম। প্রবল ইচ্ছে জাগল পৃথিবীর আর কোথাও না যাই অন্তত আইনস্টাইনের মৃত্যুভূমি জার্মানী যাবো। কৈশোরে দু’টো বিষয় আইনস্টাইনকে ধাঁধায় ফেলেছিল। প্রথমটি হলো, আলোর গতি যেহেতু সেকেন্ড প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার এবং আমি যদি ৩ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারি তবে আলোর তরঙ্গ গতিহীন স্থির হয়ে যাবার কথা। এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন সাধারণ আপেক্ষিকতা (১৯০৫) ও বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (১৯১৫)। এতোদিন মনে করা হত সময় একক সত্তার অধিকারী। পৃথিবীর ১ ঘন্টা মঙ্গল গ্রহেও ১ ঘন্টা। আইনস্টাইন প্রমাণ করলেন পৃথিবীতে ঘন্টায় ১০০ কিঃ মিঃ গতিতে গাড়ী চালালে আমার লাগবে ১ ঘন্টা। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ৩৮%। সুতরাং মঙ্গলে ১০০ কিঃ মিঃ পার হতে গাড়ীতে ১ ঘন্টার চেয়ে কম সময় লাগবে। পদার্থবিজ্ঞানের নিত্য নতুন সব তথ্যের ব্যাখ্যা মিলে আইনস্টাইনের তত্ত্বে। ইনিই প্রথম দাবি করলেন ঈশ্বরের ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় নয় বরং পদার্থবিদ্যার নিজস্ব নিয়মে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে “ল্যা মাত্রে” ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের প্রস্তাব করলেন। এডুইন হাবল প্রমাণ করলেন সিঙ্গুলারিটিতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ থেকে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও বিকাশ। যদিও বিগ ব্যাং পরবর্তী মুহূর্তে প্রকাশিত রাসায়নিক অনুপাতে দেখা যায়, ৭৬ ভাগ হাইড্রোজেন ২৪ ভাগের কিছু কম হিলিয়াম গ্রহণযোগ্য হলেও মাত্র ০০০০০৭ ভাগ লিথিয়ামের উপস্থিতি নিতান্তই কম। এই সামান্য লিথিয়াম উপস্থিতির কারণে ব্রহ্মাণ্ড অনবরত সম্প্রসারণের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। যাইহোক আইনস্টাইনের মৃত্যুভূমি দেখবো না এটা কি হয়? এই অতৃপ্ত বাসনার ক্ষুধা মিটাতে সপ্তাহ ধরে জার্মানী ঘুরে বুঝলাম জার্মানরা আসলেই অভিজাত্যের ধারক বাহক। ঐ ভূখন্ডেই প্রকৃতির নিয়মে হিটলার ও আইনস্টাইনের মতো প্রতিভার জন্ম নেয়াটাই স্বাভাবিক।

লেখক: আইনজীবী আপিল বিভাগ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবিলীন হওয়ার পথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য-অনুষঙ্গ