প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোর গ্যাং মোকাবেলার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথাগতভাবে যেভাবে অপরাধীদের মোকাবেলা করা হয় সে রকম না করে কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিতে বলেছেন তিনি। আর এই কাজে অভিভাবক, শিক্ষক এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। গত ৮ এপ্রিল বিকেলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের যখন মোকাবেলা করা হয়, সে ক্ষেত্রে যেন মনে রাখা হয় তারা ভবিষ্যতের নাগরিক। প্রথাগত অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যেন না মিলিয়ে ফেলা হয়। তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সিলিং করার ব্যবস্থা, কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা–এই ধরনের সুযোগ–সুবিধাগুলোও যেন রাখা হয়।
বলা অনাবশ্যক যে, নানা ধরনের অপরাধে কিশোররা জড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধের পরিধিও বেড়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর কারণ বেশ কিছু গবেষণা থাকলেও সেগুলোর প্রতি নজর বা তা থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দেখি না। আইন ও নীতিমালা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কিশোরদের মধ্যে পড়াশোনার চাপ ও আগ্রহ দুটিই কমে গেছে। এতে পাড়ায়–মহল্লায় চায়ের দোকানে কিশোরদের আড্ডা বেড়ে গেছে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে এলাকাভিত্তিক গ্রুপগুলো। তারা নিজেদের দল ভারী করতে এসব কিশোরকে দলে টানছে। এর মধ্য দিয়েই কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে মাদক–ইভটিজিং–ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিতেও।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এসেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এবার একটু মাথা ঘামাবে–সে প্রত্যাশা আমরা রাখতে পারি।
সমাজবিশ্লেষকরা বলেন, ‘কিশোর গ্যাং কালচার বা কিশোর অপরাধ বন্ধ করার জন্য আমাদের রাজনীতিকদেরকেই মূল বা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সন্ধ্যার পর দলবদ্ধ কিশোরদের রাস্তাঘাটে–মার্কেটে আড্ডারত দেখলেই কৈফিয়ত চাইতে হবে এবং ঘরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতে হবে। কিশোর অপরাধীদের জন্য পর্যাপ্ত রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো কিশোর অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হলে, সে যেন আইনের সঠিক আশ্রয় পায় (সঠিক বিচার হয়) সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অভিভাবকদের তাঁদের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কি করে–তা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকা পিতা–মাতার নৈতিক দায়িত্ব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেছেন, ‘অপরাধের ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধ আমাদের দেশে নতুন ট্রেন্ড। দেশে অপরাধের তিনটি চ্যালেঞ্জ লক্ষ্য করেছি। এগুলো হচ্ছে জঙ্গিবাদ, মাদক আর তৃতীয়টি সাইবার অপরাধ।’
কিশোরদের এসব অপরাধে ধাবিত করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে ছেলে–মেয়েদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িয়ে রয়েছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ফলে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হলেও সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
বলা বাহুল্য যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এখন ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, যে কিশোর–তরুণ দেশের ভবিষ্যৎ, দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা উৎকণ্ঠার বিষয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মই যদি উচ্ছনে কিংবা গোল্লায় যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু থাকে না। বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে এক–দুজনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যথেষ্ট। এ বিবেচনায়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত অসংখ্য বিপথগামী কিশোরের উৎপাত সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি–শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও ত্রাস সৃষ্টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত ও নির্মূল করা না যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য গ্রেপ্তার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করে ঠিকই, তবে তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। যেহেতু কিশোরদের অপরাধের ক্ষেত্রে সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তাই এক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে।