আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিন

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৮ মার্চ, ২০২৫ at ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান সময়ে দেশের সমাজ ব্যবস্থায় অবক্ষয়ের যে চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, নৈতিকতার বিপর্যয়ে যেভাবে রোগাক্রান্ত পুরো মানব সমাজ এত্থেকে উত্তরণ জরুরি। সারাদেশে সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পিটিয়ে হত্যা, নারীশিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হামলা, দখল, চোরাচালান, মাদক ব্যবসার মতো অন্তত ১১ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ না থাকায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘সমাজে অপরাধমূলক নানা ঘটনায় স্পষ্ট যে মানুষ কতটা অসহিষ্ণু এবং ভুক্তভোগীরা কত অসহায়।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে ঘাটতির বিষয়টিও দৃশ্যমান। দায়িত্বশীলদের সঠিক জবাবদিহির আওতায় না আনায় ও আইন মেনে চলার চর্চা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এসব ঘটনার পেছনে অনেকাংশে দায়ী বলে তাঁরা মনে করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নারীরা নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। চলতি বছর প্রথম দুই মাসে রাজধানীতে ২৬৯টি নারী শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজে একদিকে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরে নারীরা প্রায়ই বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক নির্যাতন আজও আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। তাঁরা বলেন, নারী নিপীড়ন শ্লীলতাহানী ও ধর্ষণের পাশাপাশি চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির বেপরোয়া প্রবণতা নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগের। এ পরিস্থিতি শঙ্কা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে জনমনে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে তথ্য এসেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। যা আমাদেরকে আইয়্যামে জাহেলিয়তের দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। মধ্যযুগীয় বর্বরতার ইতিহাস খুঁজেও এ ধরনের নৃশংসতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে হত্যাসহ ১১ ধরনের অপরাধ বেড়েছে। জানুয়ারিতে ২৯৪টি হত্যা মামলা হয়েছে। গত দুই মাসে রাজধানীতে মামলা হয়েছে ৩১৫৭টি। গত দুই মাসে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে ১১৪১ জন। চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার ১৭৩ জন।

এক দশকে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র। গত কয়েকদিনে এ চিত্র আরও ভয়ংকরভাবে আমাদের সামনে এসেছে। আমরা উদ্বিগ্ন আমাদের কন্যা সন্তানদের নিয়ে। এই পরিবার বা সমাজেই ঘাপটি মেরে বসে আছে সেই সব নরপিশাচরা। গড়নে মানুষ হলেও প্রকৃত মানুষের গুণাগুণ নেই তাদের মধ্যে। তাদের কাছে একবিন্দুও নিরাপদ নয় পরিবারের কন্যা সন্তানেরা। ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ী গ্রামে শিশু আছিয়ার সঙ্গে এমনই এক বীভৎস ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছে দেশের মানুষ। অপরাধীর বিচার বা শাস্তি না হওয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ধর্ষণের শাস্তির জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে। নারী দিবসের প্রথম প্রহরেই ঘটে যাওয়া একজন নারী শিশুর ওপর এমন অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন আইয়্যামে জাহেলিয়তের যুগেও ঘটেনি। এই পাশবিক ঘটনা মেনে নিতে পারছে না দেশের বিবেকবান নারী ও পুরুষরা। সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো, ধর্ষিত নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়। এমনকি পুড়িয়ে ফেলার নজিরও রয়েছে এদেশে। নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাগুলির বিচার আটকে থাকে দীর্ঘসূত্রতার জালে। বিচারের সময় আসামির জামিন, ভুক্তভোগী নারীর ও অভিভাবকের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। দেখা গেছে যৌন হয়রানির শিকার নারীর মামলার বাদিকে হত্যা করা হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘নারীদের ওপর সহিংসতা’ শীর্ষক জরিপ ২০২৪ এর প্রাথমিক প্রতিবেদন, সেখানে ওঠে এসেছে দেশে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র। গত এক দশকে এর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৬ ভাগ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নির্যাতন মূলক আচরণের শিকার হয়েছেন।

২০২৪ সালে ২২৪ টি কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যদিওবা এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই। কারণ অধিকাংশ সময় শিশুরা এ ধরনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে ভয় পায়। তথ্যমতে এ বছরে ধর্ষণের পর ৮১টি কন্যাশিশুর হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ১৩৩ টি কন্যাশিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছে।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক ব্যাধি ও সামাজিক সমস্যাতো বটেই। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবর্তীতে স্কুল কলেজ যথাযথ জ্ঞানচর্চা, নৈতিক মূল্যেবোধ জাগ্রত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপার কাজ করে। কোন স্থানে একজন ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায়, এক নাগাড়ে বিভিন্ন স্থানে একই ঘটনা হতেই থাকে। এটা হয় কারণ, যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি তারা ঘটনার সংবাদটি শুনে উদ্বুদ্ধ হয়। অবদমিত প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অবক্ষয়ের জর্জরিত এ সমাজ ব্যবস্থা হতে উত্তরণের জন্য আইনের প্রয়োগ কঠোর হওয়া উচিত। পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আইনের দৃষ্টান্তমূলত শাস্তি হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগও হচ্ছে না। মূল্যেবোধ, আদর্শের অবক্ষয় হচ্ছে। বিকৃত যৌন আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারে অভিভাবকের শাসন ও আগের ন্যায় হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যৌন শিক্ষার ধারণা না থাকায় যৌন আগ্রহটা বেশি। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি সাধারণের আগ্রহী হওয়াটা লক্ষ্যণীয়। ধর্মীয় মূল্যবোধে এবং সামাজিক কঠোর বিধি নিষেধ এখন খুবই প্রয়োজন।

পরিবারের মাধ্যমে, স্কুল, কলেজ, পাঠশালা, সমাজের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা কাজে লাগিয়ে এর প্রতিকার করা এবং সমাধান সম্ভব। শিশুদের নৈতিকতাবোধ শিখাতে হবে। ভালো কাজের পার্থক্য বোঝাতে হবে। আমরা শিশু বেলায় বাল্যশিক্ষায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নীতিবাক্য পড়েছি। বর্তমানে তা পুনরায় শিশুকাল হতে প্রাথমিক পাঠে নতুনভাবে পড়াতে হবে। ছেলেমেয়েরা যাতে একে অপরকে সম্মান করতে শেখে। ভিন্ন ধর্মবর্ণমত বর্ণের প্রতি শিশু বয়সেই শ্রদ্ধাশীল হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করতে হবে। নারীকে নারী হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে দেখার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষিত হলে আলোকিত হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে তাতে দেশেরই মঙ্গল। দেশের উন্নতির সম্ভাবনা। তাদেরকে পিছনে রাখলে, এগোতে না দিলে দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার বঞ্চিত থাকতে বাধ্য করলে কোন অবস্থাতেই দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। দেশের বর্তমান পরিবেশে আমি আমার কন্যা সন্তান নিয়ে শংকিত। এ শংকা হতে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

আমাদের প্রত্যাশা, অবনতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কঠোর হস্তে দমন করা হবে অপহরণচাঁদাবাজিসন্ত্রাসীমব জাস্টিসযৌন হয়রানির ন্যায় সব ধরনের অপরাধ।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধৈর্য, আত্মবিশ্বাস ও অধ্যবসায় শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের শিশু-কিশোর উপযোগী সাময়িকী : শিশুসাহিত্যের অগ্রযাত্রার মূল মাধ্যম