আঁরার মাইয়্যা জিতাইয়্যে

সমির মল্লিক ও প্রান্ত রনি | বৃহস্পতিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

আঁরার মাইয়্যা আবার জিতাইয়্যে, খুব খুশি লার আঁরাত্তুন’। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের জয়ের পর খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির প্রত্যন্ত সুমান্ত পাড়ার বাসিন্দা অসীম চাকমা এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া জানান। খাগড়াছড়ির দুর্গম উপজেলা লক্ষ্মীছড়ির সুমান্ত পাড়ায় মনিকা চাকমার বাড়ি হওয়ায় আনন্দউচ্ছ্বাস আরেকটু বেশি। পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে রাত ৯টা মানে গভীর রাত। মোবাইলে কথা হয় সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। সবার কণ্ঠে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ তাদের কিছুটা বেশি। কারণ ফাইনালে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম গোলটি দিয়েছে এই গ্রামের মেয়ে মনিকা। জয় সূচক গোলটি দিয়েছেন পাহাড়ের আরেক মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমা। বৃহত্তর চট্টগ্রামের এই দুই মেয়ে ফুটবলারের গোলেই বাংলাদেশ পুনরায় চ্যাম্পিয়ন হয়।

গতকাল বুধবার কাঠমন্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ২০২৪ আসরের জমজমাট ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ২১ গোলে হারিয়েছে পিটার বাটলারের শিষ্যরা। সাফে বাংলাদেশের মেয়েদের এটি টানা দ্বিতীয় শিরোপা। ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত গত আসরের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচও হয়েছিল এই দুই দলের মধ্যে। ভেন্যুও ছিল একই। সেবার নেপালকে ৩১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ নারী ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। গতবারের মতো এবারও অপরাজিত থেকে শিরোপা জিতল তারা।

মনিকার গ্রাম দুর্গম সুমান্ত পাড়ার বাসিন্দা কিরণজয় চাকমা ও কুহেলি চাকমা জানান, এর আগেও মনিকা চাকমা বাংলাদেশকে জিতিয়েছে। টানা দ্বিতীয়বারের সাফ নারী চ্যাম্পিয়নে আমাদের মেয়েরা জয় এনেছে। আমাদের খুব গর্ব হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল মনিকা গোল করবে। তা সত্যি হলো।

মনিকার বাবা বিন্দু কুমার চাকমা বলেন, ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা মনিকার। বাবামা হিসেবে প্রথমে মেনে নিতে পারিনি। এ জন্য প্রায় সময় মারও খেতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু আমরা এখন মনিকাকে নিয়ে গর্বিত। ফুটবল খেলার মাধ্যমে মনিকা এখন সারা দেশে এলাকার সুনাম বাড়িয়েছে। সে এবারও বাংলাদেশকে জিতিয়ে এনেছে। খুব আনন্দ হচ্ছে আমাদের।

লক্ষ্মীছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবীর কুমার চাকমা বলেন, দুর্গম পাহাড় থেকে জাতীয় পর্যায়ে আগেই আলো ছড়িয়েছেন মনিকা। কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে তার বাড়ি যেতে হয়। একজন মেয়ে হয়েও শত বাঁধা ডিঙিয়ে ফুটবল শৈলির মাধ্যমে জাতীয় দলে জায়গা করে নেয় সে। এরপরই বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে লেখা হয়ে গেলো মনিকা চাকমার নাম।

জয়সূচক গোলটি যার পা থেকে এসেছে সেই ঋতুপর্ণা চাকমার গ্রামের বাড়ি রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম মগাছড়ি গ্রামে। যেখানে যাওয়ার জন্য ভালো সড়কও নেই। পায়ে হাঁটা পথের গ্রাম থেকে উঠে আসা ঋতু আজ দেশের সাফল্যের তারকা। পাহাড়ের এই কন্যাদের এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত সকলেই। ছোটবেলায় মারা গেছেন ঋতুপর্ণার বাবা। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে গেল বছর মারা গেছে ছোট ভাইটিও। পরিবারের অভিভাবক হিসেবে আছেন মা পরজপতি চাকমা।

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মেয়ের সাফল্যে অনুভূতি জানতে ঋতুপর্ণা চাকমার মা পরজপতি চাকমার মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তার সংযোগ পাওয়া যায়নি। তবে ঋতুপর্ণা চাকমা ও মনিকা চাকমাদের বেড়ে উঠার সময়কার ফুটবল কোচ শান্তি মনি চাকমা জানান, আমার বর্তমান সময়ের উদীয়মান খেলোয়াড়দের নিয়ে আজ মোবাইলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা দেখেছি। পুরো ম্যাচে সবাই ভালো খেলেছে। ঋতুপর্ণার দুর্দান্ত গোলে আবারও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বিজয়ী হলো বাংলাদেশ। এটি সারাদেশের জন্য গর্ব। আমাদের আনন্দের ভাষা নেই। আমরা চাই তারা দেশের জন্য আরও সাফল্য বয়ে আনুক।

বাংলাদেশের এমন জয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, দেশে ফিরলে মনিকা চাকমাকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে সাফ নারী ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ নারী খেলোয়াড়কে সংবর্ধনা দিয়েছিল দৈনিক আজাদী। জামালখানে সেদিনের উৎসবে ছিলেন এবারের ফাইনালের দুই গোলদাতা মনিকাঋতুপর্ণা এবং সাফের পর পর দুই আসরের সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমাও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে ৩ ইউপিডিএফ কর্মীকে গুলি করে হত্যা
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে হাসিনার ফ্যাসিস্ট দলের কোনো স্থান নেই