২০৫০ সালের কোনো এক সকালে হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাবেন-চারদিকে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ওষুধ আছে, কিন্তু কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করছে না। প্রায় সবাই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। এমন দিনের সম্ভাবনা খুব দূরে নয়। বলা হয়ে থাকে, পরবর্তী মহামারী হবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মহামারী। দেশে নিউমোনিয়া আক্রান্ত ৬৪ ভাগ শিশুর মধ্যেই দেখা গেছে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা। বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ৬ শতাংশ শিশুর শরীরে পাওয়া গেছে সুপারবাগ- অর্থাৎ কোন অ্যান্টিবায়োটিক তার শরীরে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করছে না। বয়স্কদের মাঝে ব্যাপকহারে বেড়ে যাচ্ছে মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্স। ৬৫ ভাগের প্রবীণের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তিনটি কিংবা তারও বেশী এন্টিবায়োটিক একেবারে অকার্যকর তাদের শরীরে। এগুলো সবগুলোই গত পাঁচবছরে প্রকাশিত আমাদের এবং বাংলাদেশের অন্যান্য গবেষকদের প্রাপ্ত তথ্য। ভয়ংকর এক ভবিষ্যতের দিকে আগাচ্ছে বাংলাদেশ এবং পুরো বিশ্ব।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance ) হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক তাদেরকে দমন করা বা নষ্ট করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিভাবে সম্ভব? ব্যাকটেরিয়া নিজেদের শরীরে এন্টিবায়োটিককে প্রবেশ করতে না দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক কে ভেঙ্গে ফেলে এমন যৌগ বা এনজাইম তৈরি করলে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে দেয়ার এই ক্ষমতা জীবাণুদের পরবর্তি প্রজন্মের মাঝেও ছড়ায়। এই যেমন, টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ৬০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এখন সিপ্রফ্লক্সাসিন অকার্যকর দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১০ লাখে পৌঁছাবে।
শিশু, তরুণ, প্রবীণ- সব বয়সের মানুষের মাঝে দেখা যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তথা অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে পরিচালিত আমাদের গবেষণায় অনেক নবজাতক শিশুদের মাঝেও দেখা গেছে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। বিভিন্ন হাসপাতালের চাদর, সাকার মেশিন, বেসিনে পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ক্ষমতা সম্পন্ন জীবাণু। কোথায় নেই এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা? আমাদের সামপ্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে দেশের সামুদ্রিক নমুনায় পাওয়া যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। চট্টগ্রামের কালুরঘাট কিংবা মদুনাঘাটের মত এলাকার পানি, মাটি আর মাছের নমুনায় পাওয়া অণুজীবগুলোতে দেখা গেছে ৬০ ভাগেরও বেশী ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে এরকম অণুজীব। গত বছর প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামের ওয়াসার পানিতে পাওয়া গিয়েছে টাইফয়েডের জীবাণু এবং তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর এমন জীবাণু। তার মানে আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারের পানিও এখন আর নিরাপদ নেই।
কেন বাড়ছে এই অকার্যকারিতা? এন্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ না করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খাওয়া বন্ধ করে দেয়া, পশু পাখি ও মাছের খাদ্যে এন্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ- এসব কারনেই ছড়িয়ে পড়ছে এই ভয়াবহতা। জিনে রাসায়নিক পরিবর্তন বা মিউটেশনের ফলে অনেক জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম হয়ে যায়। কোটি জীবাণুর মধ্যে একটির সামান্য পরিবর্তনই দ্রুত বংশবিস্তারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই পরিবর্তিত জিন অন্য জীবাণুতেও ছড়িয়ে রেজিস্ট্যান্স আরও বাড়ায়। ফলে এসব জীবাণুতে আক্রান্ত রোগী সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকে আর সহজে সেরে ওঠে না, রোগের তীব্রতা বাড়ে, এমনকি কার্যকর ওষুধ না থাকলে মৃত্যুঝুঁকিও দেখা দিতে পারে।
মানুষ আসলে কতটুকু জানে এন্টিবায়োটিক সম্পর্কে? এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিষয়েই বা তারা কতখানি অবগত? বিএমসি ওপেন এ প্রকাশিত আমাদের আরেকটি গবেষনায় দেখা গেছে এ প্রকাশিত আমাদের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে- পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৬৫ শতাংশ মানুষ জানে না কখন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া উচিত এবং কেন এগুলো ব্যবহৃত হয়। শহরের ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। প্রধান কারণ ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতা; অনেক ক্ষেত্রে বিক্রেতারাই অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
উন্নত বিশ্বে জিনোমিক সার্ভিলেন্স এবং জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত নজরদারি চলছে-কোথায় কী ধরনের রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু তৈরি হচ্ছে, কিভাবে ছড়াচ্ছে, তা বোঝার জন্য। আমাদের দেশে এমন কার্যক্রম এখনো খুব সীমিত। জেলা পর্যায়ে পিসিআরসহ আধুনিক টেস্টগুলো নিয়মিত হলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স শনাক্তকরণ আরও নির্ভুল হতো। দেশে আইসিডিডিআরবি, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, আইইডিসিআর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বহু বছর ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ধরন ও অকার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করছে। কিন্তু এই গবেষণার তথ্য সরকার তেমন গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করছে না। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলা এখনো সভাুসেমিনারুরিপোর্ট তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ; নেই শক্তিশালী আইন প্রয়োগ, নেই কার্যকর সচেতনতা উদ্যোগ, নেই ফার্মেসিগুলোর নিয়মিত তদারকি।
এই মহামারী থামাতে হলে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষক, চিকিৎসক, হাসপাতাল, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে স্বাস্থ্যনীতি থাকলে হবে না; আইন ও নীতির বাস্তব প্রয়োগ জরুরি। একটি স্বাস্থ্যকর আগামী নিশ্চিত করতে হলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের বিরুদ্ধে এখনই যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,












