অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণের গল্প শোনালেন মহুয়া রউফ

রাঙ্গুনিয়ায় নিজ গ্রামে সংবর্ধনা

জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া | বুধবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের সন্তান মহুয়া রউফ। সম্প্রতি তিনি পৃথিবীর দক্ষিণতম বরফাবৃত মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করেছেন। তিনি ছাড়াও অ্যান্টার্কটিকায় দেশের পতাকা উড়িয়েছেন আরও দুজন। তাদের একজন রাঙ্গুনিয়ার সন্তান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং অপরজন লক্ষ্মীপুরের সন্তান, চট্টগ্রাম শহরে বেড়ে ওঠা এভারেস্ট জয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীন।

রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী মহুয়া রউফ গতকাল বিকালে স্কুলের শিক্ষকশিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীকে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণের ১২ দিনের রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়েছেন এবং এর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করেছেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি এবং মহুয়া রউফের পিতা আবদুর রউফ মাস্টার। প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গনি ওসমানী।

মহুয়া রউফ তথ্যচিত্র ও ভিডিও প্রদর্শনীর সাহায্যে অ্যান্টার্কটিকায় তার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। যেখানে তিনি লালসবুজ পতাকা হাতে কখনো বরফের পাহাড়ে, কখনো হিমশীতল সাগরে বিশালাকার তিমির কাছাকাছি থাকার ছবি, কখনো বরফের পাহাড় খুঁড়ে সেখানে রাত্রীযাপনের ছবি প্রদর্শন করেন। তিনি সাক্ষী হয়েছেন বরফের বিশাল আইসবার্গ ও অপার্থিব সৌন্দর্যের। সাগরে ঘুরে, কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় পেঙ্গুইনের রাজ্য দেখেছেন কিংবা এক হাত ব্যবধানে থেকে দেখেছেন বিশালাকার তিমি। এভাবে পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হয়েও ছুঁয়ে এসেছেন পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু।

মহুয়া জানান, তিনি পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় ভাবলেন, পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণের শেষ শহর আর্জেন্টিনার উশুইয়াতে ভ্রমণে যাবেন। তখনই মাথায় এলো, উশুইয়াতে যখন যাবেন, অ্যান্টার্কটিকায় নয় কেন? কারণ পৃথিবীর যে পাঁচটি জায়গা থেকে অ্যান্টার্কটিকায় যাওয়া যায় তার মধ্যে উশুইয়া শহর অন্যতম। বাকিগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চিলি। এসব স্থান থেকে জাহাজ ছাড়ে অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশ্যে।

অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাদ সাধল আর্জেন্টিনার ভিসা। ভিসার জন্য ইমেইল করেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছিলেন না। ভাগ্য ভালো যে, ভুল করে দূতাবাসের একজন তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে ইন্টারভিউয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন আর্জেন্টিনা যেতে চাও? তিনি বললেন, আমাদের দেশের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন, তাই। এর দুই ঘণ্টা পরই ভিসা দিয়ে দিল।

তিনি বলেন, আর্জেন্টিনার উশুইয়া শহর থেকে যে জাহাজগুলো ছাড়ে সেগুলোর প্যাকেজ ছয় মাস কিংবা এক বছর আগে থেকে শেষ হয়ে যায়। এভাবে নানা শঙ্কার মাঝেও প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাঝে তিনি ব্রাজিল, চিলি হয়ে আর্জেন্টিনার উশুইয়া শহরের বিমানের টিকিট কাটেন এবং এর মধ্যে অ্যান্টার্কটিকার প্যাকেজের জন্য খোঁজ নেন। হঠাৎ একটি এজেন্সি থেকে অ্যান্টার্কটিকার প্যাকেজ পেয়ে যান। যেদিন খবর পান সেদিনই অফেরতযোগ্য ২০ শতাংশ বুকিং দিয়ে সেটি সংগ্রহ করতে হবে বলে জানলেন। তিনি সেই প্যাকেজ নিলেন। সব মিলিয়ে তার প্রায় ১৫ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এরপর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের হোটেলে রাখা হয়। হোটেলে রাশিয়ার নারী নাসতার সঙ্গে পরিচয় হয়। নাসতা তাকে বললেন, তুমি হবে আমার ১২ দিনের সঙ্গী। সেখানে এক রাত থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি জাহাজে উঠলেন অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। জাহাজে অভিযাত্রী ছিল ১১৪ জন। রান্নার লোক ও গাইড মিলিয়ে সহযোগিতার জন্য ছিলেন আরও ৭২ জন।

মহুয়া রউফ বলেন, জাহাজের দুলুনিতে দুদিন অসুস্থ ছিলাম। অস্বাভাবিক দুলুনিতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি। এছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি। জাহাজে জার্মানি, টার্কিশ আর আমিসহ চারজন মেয়ে সহযাত্রী বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে নাসতা ছিল আমার কেবিন বন্ধু। সবাই আমাদের ডাকত ‘চার সাহসী নারী’।

একসময় লিডার মারিওর ঘোষণা দিলেন, আমরা অ্যান্টার্কটিকা বলয়ের মধ্যে চলে এসেছি। জাহাজ নোঙর ফেলার আগমুহূর্তে সুস্থ হয়ে উঠি। যার পরনে যা ছিল সেই অবস্থায় কেবিন থেকে দৌড়ে বারান্দায় আসি। মনোরম দৃশ্য। পানির মধ্য থেকে ভেসে ওঠা পাহাড়। ভাঙা ভাঙা বরফ, বড় বড় আইসবার। এ দৃশ্য দেখে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হলাম। মোবাইলে এ দৃশ্য ধারণ করলাম। এরপর লিডার মারিওর ঘোষণা দিলেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা অপারেশন শুরু হবে। সবাইকে চার গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘এ’ গ্রুপে সবার উপরে নিজের নাম দেখতে পেয়ে আনন্দিত হলাম।

মহুয়া রউফ বলেন, ১০ জন করে একটি জোডিয়াকে উঠলাম। যিনি গাইড করছেন তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। উত্তাল সমুদ্রে ছোট প্লাস্টিকের নৌকায় চড়ে প্রথম কিউভার ভ্যালি আইল্যান্ডে গেলাম। পাহাড় ও পেঙ্গুইনের অভয়ারণ্য। সামনে থেকে প্রথম পেঙ্গুইন দেখলাম। দ্বিতীয় অপারেশন অনেকগুলো পাহাড় নিয়ে গড়ে ওঠা পোর্ট লকরয় আইল্যান্ডের পেঙ্গুইন পোস্ট। এই আইল্যান্ডে ব্রিটিশ, সুইডিশ অনেক বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী, গবেষকরা এখানে এসেছেন জানার জন্য। থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন ছোট ছোট ঘর। এখানে কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশরা এখানে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করে। বিশাল সংগ্রহশালা এটি তাদের। ১৯৯৬ সালে একটি ঘরকে তারা পোস্ট অফিস তৈরি করে নাম দেয় পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস। অভিযাত্রীরা ওই পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্টকার্ড কিনে চিঠি লিখে স্ট্যাম্প লাগিয়ে পোস্টবঙে ফেলে আসতে পারেন। আমি আমার দুই ছেলের জন্য দুটি চিঠি লিখে পোস্ট করে এসেছি। অ্যান্টার্কটিকা ক্যাম্পিং করার জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় একটি বরফের পাহাড়ে। অভিযাত্রীরা আয়তাকার গর্ত করে। সেখানে ফোমের মতো বিছিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শরীর ঢোকায়। মুখ বের করে শুয়ে থেকে আকাশের সৌন্দর্য অনুভব করেন। তিমি অপারেশন ছিল আরেকটি মজার অপারেশন। এত বড় বড় তিমি ছোট ছোট জোডিয়াক দেখেও উল্টে দেয়নি।

মহুয়া যখন বলছিলেন সবাই চুপ হয়ে শুনছিলেন। তিনি জানালেন, অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অন্য অভিযাত্রীদের সঙ্গে কখনো ক্যাম্পিং, হাইকিং, জডিয়াকে ঘুরে দেখেছেন অ্যান্টর্কটিকার নিজস্ব রূপ। যেদিকে চোখ যায় শুধু সাদা পাহাড়, পাথর আর বরফে ঢাকা প্রান্তর। বিভিন্ন ধরনের পাখি, পেঙ্গুইন, সিল ও তিমি। গাছ নেই, তারপরও বাতাস সতেজ। ঠান্ডাটাও আরামদায়ক বলে জানালেন তিনি।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ কিংবা বিশ্ব পরিব্রাজক হওয়ার পেছনে ছোটবেলা থেকে পিতামাতার সাহস, স্কুলের শিক্ষকদের প্রেরণা তাকে শক্তি জুগিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে আমি নজিবুল বশর এমপি হয়ে লাভ নাই’
পরবর্তী নিবন্ধঅনুশীলনে সাকিবের ব্যাটিং আশা জাগাচ্ছে দলকে