সারা বিশ্বে অ্যাটর্নি জেনারেল পদের কাজ হচ্ছে সে দেশের সরকারের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়ন করা। দেশে দেশে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নানা নামে অভিহিত করা হয়, যেমন– চীফ সলিসিটর, এডভোকেট জেনারেল, চীফ ‘ল অফিসার, চীফ লিগ্যাল অফিসার ইত্যাদি। কিছু কিছু আইন বিশেষজ্ঞের মতে অ্যাটর্নি জেনারেল পদটা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক পদ। অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারকে সংবিধান, সাধারণ আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনগত পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষে আদালতে উপস্থিত থাকেন। বলা যায় অ্যাটর্নি জেনারেল হলো সরকারের আইনগত পরামর্শক বা প্রধান আইন কর্মকর্তা। তিনি মহামান্য হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট এ মামলা মোকদ্দমায় রাষ্ট্র পক্ষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ রক্ষা করেন। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবিধানিক পদ নয়। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ পদ। সাংবিধানিক পদ হচ্ছে সে সকল পদ, যেগুলোর মেয়াদ সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত, সংবিধান দ্বারা রক্ষিত। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেলের মেয়াদ নির্দিষ্ট করা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৪(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উত্থাপিত যেকোনো রেফারেন্সের ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব মত প্রকাশ করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অনুচ্ছেদ ৬৪(৪) অনুসারে রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীয় পদে বহাল থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত পারিশ্রমিক লাভ করবেন। বাংলাদেশে অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকার বলে সারা দেশের বার সমিতি সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর চেয়ারম্যান। বলা যায় অ্যাটর্নি জেনারেল হলো সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা আইনগত পরামর্শক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ সিনিয়র এডভোকেট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জনাব আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন স্যার বর্তমানে পদাধিকার বলে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ১৬তম অ্যাটর্নি জেনারেল। বিখ্যাত আইনবিদ এম এইচ খন্দকার স্যার ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে তাঁকে সহায়তা করার জন্য একাধিক এডিশন্যাল অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল রয়েছে ।
ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন ভারত সরকারের প্রধান আইনী উপদেষ্টা। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৬(১) এর অধীনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুরোধে ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন এবং রাষ্ট্রপতির খুশির সময় কাল পর্যন্ত পদে অধিষ্ঠিত হন।
আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেল: অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার একজন সংবিধিবদ্ধ সদস্য। ওয়াশিংটন, ডিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের নিয়োগ ধারার অধীনে, অফিসহোল্ডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হন, তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটের পরামর্শ এবং সম্মতিতে নিযুক্ত হন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় দ্বারা সমর্থিত করা হয়, যার মধ্যে নির্বাহী কর্মী এবং বেশ কয়েকটি ডেপুটি অন্তর্ভুক্ত থাকে ।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের জন্য মহামান্য অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে সার্বভৌম এবং সরকারের প্রধান আইনী উপদেষ্টা এবং ক্রাউনের আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার। অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের নেতা এবং তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দেন (কিন্তু সদস্য নন)।
পাকিস্তানের অ্যাটর্নি–জেনারেল হলেন পাকিস্তান সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা এবং আইনি উপদেষ্টা এবং সংসদের সামনে দর্শকদের অধিকার উপভোগ করেন। অ্যাটর্নি–জেনারেল, যিনি পাকিস্তানের পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা সুপারিশ করা হয় এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। সংবিধান অ্যাটর্নি–জেনারেলকে তার চাকরির অবসান না হওয়া পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিস থেকে নিষিদ্ধ করে। অফিসটি ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্রীলঙ্কার অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রধান আইনি উপদেষ্টা এবং শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্টে তার প্রাথমিক আইনজীবী। অ্যাটর্নি জেনারেল সাধারণত একজন অত্যন্ত সম্মানিত সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবং ক্ষমতাসীন সরকার দ্বারা নিযুক্ত হন। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন সঞ্জয় রাজারত্নম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের বিপরীতে, শ্রীলঙ্কার অ্যাটর্নি জেনারেলের কোনো নির্বাহী কর্তৃত্ব নেই এবং তিনি একজন রাজনৈতিক নিয়োগকারী নন; এই ফাংশন বিচারমন্ত্রী দ্বারা সঞ্চালিত হয়। অ্যাটর্নি জেনারেলকে শ্রীলঙ্কার সলিসিটর জেনারেল এবং একাধিক অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল সাহায্য করেন।
নেপালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫৭–এর উপ–অনুচ্ছেদ ২ অনুসারে, অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধানমন্ত্রীদের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। একই উপ–অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর খুশি থাকাকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল পদে বহাল থাকবেন। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল, দিনমণি পোখারেল, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২–এ নিযুক্ত হন।
অস্ট্রেলিয়া অ্যাটর্নি জেনারেল একজন পার্লামেন্ট মেম্বার, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে গভর্নর জেনারেলের মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তাকে প্রধান ‘ল অফিসার বা Nation’s First Law Officer’ বলা হয়। তার প্রধান কাজ সাংবধানিক আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ, তদারকি করা এবং রাষ্ট্রের ৩ টি অর্গান যথা পার্লামেন্ট, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ জনগণের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তাকে রাষ্ট্রের চীফ ‘ল অফিসার বা মিনিস্টার অব এস্টেটও বলা হয়।
কানাডিয়ান অ্যাটর্নি জেনারেলকে সরকারের প্রধান আইন পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস বা বিচার বিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করতে হয়। তিনি একজন সংসদ সদস্য এবং কেবিনেট মিনিস্টার হিসেবেও কাজ করেন।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকারকর্মী।