অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িতদের বড় অংশ রাজনৈতিক মদদপুষ্ট

পুলিশ সদরদপ্তরের প্রতিবেদন ।। চট্টগ্রামে দুই মাসে গ্রেপ্তার ৯৪ জন

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ৮ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম নগরীসহ সারা দেশের হোটেলমোটেল, পিকনিক স্পট, শুটিং স্পটে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তর সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে অসামাজিক কার্যকলাপ কারা কোথায় কীভাবে করছে, এসব বিষয়ে একটি চিত্র উঠে এসেছে। পরে সেটি দেশের বিভিন্ন জেলায় সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠায় পুলিশ সদরদপ্তর। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িতদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অনেকে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত। পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, হোটেলগুলোর লাইসেন্স দেয় জেলা প্রশাসন। তাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হলে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহম্মদ ফখরুজ্জামান আজাদীকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব। অতীতেও অভিযান চালানো হয়েছে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর এ ধরনের কার্যক্রম নিষেধ করার পরও অব্যাহত রাখা হলে তাদের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।

পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তালিকা পাওয়ার পর অভিযানে নেমেছে সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম নগর ও জেলা পুলিশ। আটকের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, যাচাইবাছাইকালে দেখা গেছে, সমাজের অভিজাত শ্রেণির স্কুলকলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে আটক হয়েছে অভিযানে।

অভিযান প্রসঙ্গে ওসি কোতোয়ালী জাহিদুল কবীর আজাদীকে বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে বন্দরনগরী। তিনি বলেন, অসামাজিক কার্যকলাপ হয়তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু চট্টগ্রামে এটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেন, অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ওসি কোতোয়ালী আরও বলেন, আমরা এমনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যে, গত মাসে একটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে ছেলেমেয়ে আটক করেছি। এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে এসেছি। এরপর চলতি মাসে একই হোটেলে অভিযান চালাতে গিয়ে দেখেছি, আবারও রমরমা ব্যবসা চলছে ওই হোটেলে। এ বিষয়ে কোতোয়ালী থানার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর দুয়েকদিনের মধ্যে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ আরও বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য তিনি আকাশ সংস্কৃতি, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটকে দায়ী করে বলেন, এসব প্রযুক্তির অবশ্যই ভালো দিক আছে। পাশাপাশি খারাপ দিকও আছে। অনেক কিশোরকিশোরী খারাপ দিক সহজে গ্রহণ করছে। আবার অনেকে আর্থিক দৈন্যতা থেকে স্বেচ্ছায় ঝুঁকছে এ ধরনের অপকর্মে।

গত ৫ জুলাই রাত নয়টার দিকে এসআই মো. সেলিম মিয়ার নেতৃত্বে একটি টিম কোতোয়ালী থানাধীন স্টেশন রোডস্থ হোটেল হিলটাউন (আবাসিক) এ অভিযান পরিচালনা করে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে ১০ জনকে (পুরুষ ৬ ও নারী ৪) গ্রেপ্তার করেন। তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

নগরীর হালিশহর থানাধীন কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ চার নারী ও দুজন পুরুষকে আটক করা হয়। পুলিশ জানায়, গোপন সোর্সের খবরে ২৩ জুন রাতে অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাদের আটক করা হয়। আটকের তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন নগর গোয়েন্দা (বন্দর ও পশ্চিম) পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন।

১৭ জুন সন্ধ্যায় অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকায় পাঁচজনকে আটক করেছে পতেঙ্গা থানা পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে পতেঙ্গা থানার ওসি আফতাব হোসেন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা থানাধীন দক্ষিণ পতেঙ্গা সিবিচ রোডস্থ মহিউদ্দিনের ভাড়াঘরে অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ৫ নারীপুরুষকে আটক করা হয়।

নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন আতুরার ডিপো থেকে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গত ৬ জুন রাতে ৬ জনকে আটক করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকায় তাহেরাবাদ আবাসিক এলাকার মক্কা ম্যানশনের ৫ম তলা থেকে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৪ জুন অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে বন্দর থানা পুলিশ। বন্দর থানাধীন ইপিজেড মোড় এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা।

গত ১৯ মে নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় ‘নিরিবিলি আবাসিক’ নামে একটি হোটেলে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। হোটেলটিতে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ স্থানীয়দের। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে হোটেলটিতে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে আসছে। গত ৩ জুন হোটেলটি বন্ধের দাবিতে এলাকার নারীরা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে বলা হয়, জনবহুল এই এলাকায় জিইএম প্ল্যান্ট জামে মসজিদের সামনে নিরিবিলি নামে একটি আবাসিক হোটেলে দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলে আসছে। স্থানীয় ছাড়াও বাইরে থেকে আসা কিশোরতরুণ এই হোটেলে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এর আগে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে হোটেলটি বন্ধের দাবিতে গত ২৬ মে এলাকাটিতে হাজারো নারীপুরুষ মানববন্ধন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও র‌্যাবের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।

১৯ মে আকবরশাহ থানাপুলিশ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর আজাদীকে জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আকবরশাহ থানাধীন বাগানবাড়ী এলাকার একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকায় ৮ জন নারীপুরুষরেক গ্রেপ্তার করা হয়।

কোতোয়ালী থানা এলাকায় কয়েকটি আবাসিক হোটেল থেকে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৭ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১১ জন নারী ও ৬ জন পুরুষ রয়েছে। কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুল কবির বলেন, ১৭ মে অভিযান চালিয়ে হোটেল সিলভার ইন থেকে ৯ জন, পুরাতন স্টেশন এলাকার হোটেল মেট্রো ইন থেকে ৫ জন এবং সিনেমা প্যালেস এলাকা থেকে ৩ জনসহ মোট ১৭ জনকে আটক করা হয়।

১৬ মে নগরীর পতেঙ্গায় দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত আবাসিক হোটেলগুলোর আড়ালে প্রতিনিয়ত অসামাজিক কার্যকলাপ চলার অভিযোগ পেয়ে মহানগর গোয়েন্দা (বন্দর ও পশ্চিম) বিভাগের অভিযানে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল থেকে ১১ জনকে আটক করা হয়।

১৫ মে হাটহাজারীতে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাতে হাটহাজারী পৌরসভার মহিলা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন একটি ভবন থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে হাটহাজারী থানার ওসি রুহুল আমিন সবুজ জানান, অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ৫ নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

১৩ মে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নগরের কোতোয়ালীতে দুটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে ২৬ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী। গত বৃহস্পতিবার রাতে কোতোয়ালী থানা পুলিশ বিআরটিসি এলাকায় হিলটাউন নামে এক আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে ১৫ জন পুরুষ ও ৫ জন নারী। এদিকে ১৪ মে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কোতোয়ালী থানাধীন রাইফেল ক্লাবের বিপরীত পাশে হোটেল মুসলিম (আবাসিক) এ অভিযান চালিয়ে হোটেল ম্যানেজারসহ ৬ জনকে আটক করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতৈলারদ্বীপ সেতু মনিটরিংয়ে ৩ টিম প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা মেলেনি
পরবর্তী নিবন্ধউন্নয়নের ছোঁয়া, তবুও বদলায়নি অনেক কিছু