নদীর সাথে আমার মিতালী দীর্ঘদিনের। আমার গ্রামের পাশ দিয়েই শঙ্খ নদী বয়ে গেছে। শেফালী ঘোষের কণ্ঠে ‘পালে কী রং লাগাইলরে মাঝি/ সাম্পানে কী রং লাগাইল/ শঙ্খ খালর সাম্পানওয়ালা আঁরে/ পাগল বানাইল…’। এই নদীর সাথে কত মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত আছে তা হিসাব করে বলা যাবে না। একসময় সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। আমরা নদী পথেই চলাচল করতাম। সেই চরতী মাস্টার হাট থেকে দোহাজারী দ্বিজেন্দ্র লাল কারণ ঘাট পর্যন্ত ইঞ্জিন চালিত নৌকা করেই চলাচল করতাম। আমাদের বাড়ির পাশের যে ঘাটটি আছে সেটির নাম মোক্তারকুম। এই জায়গা থেকে নৌকা করে কখনো দোহাজারী গিয়েছি আবার কখনো বৈলতলী গিয়েছি। নৌকা করে যাওয়ার মজাটাই আলাদা। নদীর দুইপাশে সবুজের সমারোহ আজো অতীতের কাছে নিয়ে যায়।
শঙ্খ নদী বাংলাদেশের পূর্ব–পাহাড়ি অঞ্চলের চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৯৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১১৯ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার মদক এলাকার পাহাড় থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ভিতর দিয়ে অনেক পথ অতিক্রম করে অবশেষে
বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই নদীর যাত্রাপথে অনেক উঁচু উঁচু দুর্গম পাহাড়, গহিন বনাঞ্চল ও অসংখ্য পাহাড়ি জনপদ আপনাকে প্রকৃতির সাথে একাকার করে দেবে। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক বান্দরবান শহর হয়ে রুমা, থানচি যান পাহাড় এবং নদী দেখার জন্য। কেউ কেউ শঙ্খ নদীতে নৌকায় চড়ে পাহাড়ের নির্জনতা উপভোগ করার জন্য দিক বিদিক ছুটে চলেন আবার কেউ কেউ মাছ ধরার জন্য নীল জলরাশিতে নেমে পড়েন।
প্রবাদ আছে ‘মরা গরু জিয়ি গিয়ে শঙ্খ নদী ফিরে গিয়ে’। কাহিনীটি এরকম–শ্রাবণের কোনও এক ঘন বর্ষণের ভোরে খরস্রোতা প্রলয়ঙ্করী শঙ্খনদী দিঘিতে ঢুকবে পণ করে প্রবল বেগে আঁছড়ে পড়েছিল পাড়ে। মঠের ধ্যানাসনে উপবিষ্ট শ্রী শুক্লাম্বর হাতে কমণ্ডলুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন এ প্রবল স্রোতের মুখে। তিনি দিঘির জল অপবিত্র হবে ভেবে নদীকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। নদীর জল দিঘিতে ঢুকলে দিঘির জল অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিল একটি মরা গরু। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে এ সাধক হাতের কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মরা গরুটি। প্রাণ ফিরে পেয়ে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল উঁচু ডাঙায়। মুহূর্তে স্থির হয়ে গিয়েছিল উমত্ত জলরাশি। জল থেকে উঠে এসেছিলেন মকর বাহনা গঙ্গা। তিনি বর দিয়েছিলেন যে শঙ্খ নদীর জল কোনওদিন দিঘিতে প্রবেশ করবে না। স্থানটি চন্দনাইশের বরমায় শ্রী শুক্লাম্বর দিঘি নামে সুপরিচিত।
এই নদীতে শামুক থাকলেও শঙ্খ কখনো ছিলো কি না সে ব্যাপারে তেমন কোনো ইতিহাস আমি পাইনি। তবে যুগ যুগ ধরে এ নামেই নদীটিকে চেনে দু’পাড়ের মানুষ। বৃটিশরা শঙ্খ নামটি পরিবর্তন করে দাপ্তরিক কাজের জন্য সাঙ্গু নাম দিয়েছেন বলে অনেক লেখক মন্তব্য করেছেন। স্বচ্ছ জলধারার এ নদীকে অবশ্য রেস্রীইং খ্যং নামে ডাকেন স্থানীয় সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। রেস্রীইং খ্যং’ অর্থাৎ ’স্বচ্ছ নদী’। থানচি ও রেমাক্রির স্থানীদের মতে, সম্ভবত ১৮৬০ সালে বৃটিশ আমলে সরকারি গেজেটিয়ার প্রকাশের সময় বাঙালি আমলারা ‘শঙ্খ নদী’ নাম নথিভুক্ত করে। আর ইংরেজিতে এটা লেখা হয় সাঙ্গু। নাম যাই হোক না কেন বিভিন্ন ঝিরি–ঝরনার মুখে ছোট বড় পাথর দিয়ে সাজানো শঙ্খ নদীর দুই পাশের প্রকৃতি অসাধারণ। পাথরের ফাঁকে অবিরাম উচ্ছ্বল জলরাশির খেলা। স্রোতস্বিনী উজানে এখনো নদীর স্বাভাবিক চরিত্র নিয়েই টিকে আছে।
আমার গ্রামের বাড়ি শঙ্খ নদীর পাশে হওয়াতে খুব কাছ থেকে এই নদীর গতিবিধি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। শুকনো মৌসুমে এই নদী খুবই শান্ত। বর্ষাকালে শঙ্খ নদীর রূপ খুব ভয়ংকর থাকে। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে নদীর স্রোত তীব্র হতে তীব্র হয়। কোথাও কোথাও দেখা দেয় পাহাড়ি ঢল। অনেক উঁচু থেকে পানি গড়িয়ে বিনা বাধায় নীচের দিকে প্রবাহিত হয়ে অনেক গ্রামকে প্লাবিত করে। সে সময় দুপাশের জনবসতির মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ধর্মপুর, বাজালিয়া, চাগাচর, মৈশামুড়া, মরফলা, নলুয়া, খাগরিয়া, আমিলাইশ, বৈলতলী, চরতী, ব্রাহ্মণডেঙ্গার অসংখ্য বাড়ি নদীতে হারিয়ে গেছে। অনেক রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সব ধর্ম বর্ণের মানুষের বসবাস রয়েছে শঙ্খ নদীর তীরে। তবে বান্দরবানের দিকে নদীর দু’পাড়ের বাসিন্দাদের অধিকাংশই মারমা বা অন্য কোনো নৃ–গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের অধিকাংশেরই পেশা আবার জুম চাষ। নদী অববাহিকায় প্রচুর পলি জমে পাহাড়ি ঢলে। আখ, ধান, ডাল, শাক–সবজি, বেগুন, বাদামের বাম্পার ফলন। চিতল, তেলাপিয়া, চেলা, চেবলি, চাটকিনি, গুরামুইক্কা, মহাশোল, পাবদা, চিরিং, বাইম, জাত পুটি, ফান্ডা, বোয়াল, বাটা, ফান্ডা বাটা, বামশ, বেলিটুরা, কেচকি, কানকিলা, কাটা চান্দা, কই বান্দি, মৃগেল, বাইলা, গুইল্লা, ছোঁয়া চিংড়ি, গলদা চিখড়ি গুচি বাইম, ঘারুয়া বাচ্চা, কুচিয়া, আইড়, শাল বাইম, কই, দেশি মাগুর, টাকি, ঘনিয়া, চিংড়ি, জায়ান্ট গলদা চিংড়ি, রুই, ভেদা ও কাতলাসহ ৩৯টি প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। মাঝে মাঝে বড় বড় কোরাল মাছ। নদীতে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার করছে একশ্রেণীর জেলে। এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে নদীর একসময়ের সমৃদ্ধ মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য।
আপনি যখন শঙ্খ নদীর পাড় দিয়ে হাঁটবেন বিভিন্ন ফসলের ঘ্রাণে আপনার মন ভরিয়ে দেবে। বিশেষ করে শীতকালে চরের যেদিকেই যাবেন দুচোখ দিয়ে শুধু সবজির ক্ষেত দেখবেন। সবজি চাষে তুলনামূলকভাবে খরচ কম লাগায় দিন দিন চরের চাষিরা সবজির চাষে ঝুঁকছেন। স্থানীয় বাজারে এসব সবজির বেশ চাহিদা রয়েছে। চরে চাষ হওয়া সবজিগুলোর মধ্যে টমেটো, ফুলকপি, মরিচ, বেগুন, চিচিঙ্গা, মুলা উল্লেখযোগ্য। এসব সবজি চাষ করতে সার কিংবা কীটনাশক প্রয়োগ খুব বেশি করতে হয় না তাই এখানকার উৎপাদিত সবজিগুলো অন্যান্য জায়গা থেকে অনেকটাই ভেজালমুক্ত। দোহাজারীর বেগুন সবার কাছে খুবই পরিচিত। শঙ্খ নদীর তীরের বেগুনের আলাদা কদর। বিশেষ করে রোজার সময় বেগুনের দামও থাকে চড়া। সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারার শঙ্খ তীরে প্রচুর বেগুন চাষ হয়।
নদীর দুই ধারে উৎপাদিত এই সবজি দেশের অনেক চাহিদায় পূরণ করছে। এখানে উৎপাদিত শীতকালীন সবজিতেই চাহিদা মিটছে চট্টগ্রামবাসীর। তবুও ভালো নেই সবজি চাষীরা। উৎপাদন ভালো হলেও দাম নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন কৃষকরা। প্রান্তিক চাষীরা মূলত দাদনের কারণে কম দামে আড়তদারদের কাছে সবজি বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমিকের বেতন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত খরচের টাকা ওঠানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অনেকে। শীত মৌসুমেও সব ধরনের শীতকালীন সবজির দাম চড়া। এক্ষেত্রে আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হচ্ছে বলে প্রান্তিক চাষীদের অভিযোগ রয়েছে। এই সবজিগুলো যারা উৎপাদন করেন তারা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য তার দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। নদী পাড়ের অসংখ্য মানুষের স্মৃতি বিজড়িত এই শঙ্খ নদী হাজার বছর ধরে থাকুক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই নদীর অপরিসীম অবদানকে অব্যাহত রাখার জন্য এই নদী যাতে ভরাট হয়ে না যায় তার দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক