সংখ্যাটি আসলে কত তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। কেউ বলেছেন, এক লাখের বেশি, কেউবা পঞ্চাশ হাজার। সত্তর–আশি হাজারও বলছেন কেউ কেউ। তবে কেউই পঞ্চাশ হাজারের নিচে নামেননি। এটি নগরে দাবড়ে বেড়ানো ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা। নগরীতে ঠিক কতটি অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে তা জানার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও সংখ্যাটি জানা সম্ভব হয়নি। তবে নগরীতে ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য চলছে সমানতালে। অলিগলি থেকে শুরু করে রাজপথ সর্বত্র দাবড়ে বেড়াচ্ছে বিদ্যুৎখেকো, ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্যাটারি রিকশা। কোনো নীতিমালা নেই, ট্যাক্স নেই, লাইসেন্স নেই, নেই নিয়ম–কানুন। গতকাল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, অলিগলি বলে কিছু নেই, চট্টগ্রাম মহানগরীতে আর কোনো ব্যাটারি রিকশা চলবে না।
নগর পুলিশ এগারো মাস আগে শহরে নিষিদ্ধ করেছিল ব্যাটারি রিকশা। চালানো হয়েছে অনেক অভিযান। ধরা পড়েছে কয়েক হাজার ব্যাটারি রিকশা। কিন্তু মশক নিধনের মতো ব্যাটারি রিকশা ধরাধরিও কোনো প্রভাব ফেলেনি। নগরীর মশার মতো ব্যাটারি রিকশার সংখ্যাও কমেনি। এ সংখ্যা এখন লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
ব্যাটারি রিকশা নিষিদ্ধ। অথচ গলির ভিতরে চলতে দেওয়া হচ্ছে। একটি নিষিদ্ধ জিনিস গলির ভিতরে কীভাবে চলে? প্রশ্ন নগরবাসীর অনেকের। তাদের ভাষায়, একটি অবৈধ জিনিস সর্বত্রই অবৈধ। এটি গলিতে বৈধ হয় কীভাবে?
অবৈধ ব্যাটারি রিকশা নিয়ে পুলিশের লাখ লাখ টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন ব্যাটারি রিকশা মালিক ও চালক সমিতির একাধিক নেতা। তারা অভিযোগ করেছেন, প্রতিদিন নগরীর থানা এবং ট্রাফিক পুলিশ অনেক ব্যাটারি রিকশা আটক করে। সন্ধ্যার পর একেকটি গাড়ির বিপরীতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করে ছাড়া হয়। ব্যাটারি রিকশা থানা এবং ট্রাফিক পুলিশের বাণিজ্যের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্যের মাঝে সিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এতে অবৈধ ব্যাটারি রিকশায় না চড়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পুলিশ ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করতে না পেরে পুলিশের কাজটি নগরবাসীর ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মোহাম্মদ পারভেজ আহমেদ নামে খুলশীর এক বাসিন্দা। তিনি বলেন, ব্যাটারি রিকশা অবৈধ। পুলিশ অবৈধ এই রিকশা বন্ধ করবে। এটা পুলিশের কাজ। এখন পুলিশ সেটা করতে না পেরে আমাদেরকে ব্যাটারি রিকশায় চড়তে মানা করছেন। এভাবে বললে যদি কাজ হতো তাহলে দেশে চুরি–ডাকাতি, খুন হতো না। অপরাধ না করার জন্য তো সবসময়ই বলা হয়।
পুলিশের গণবিজ্ঞপ্তি প্রচারের পরদিনও নগরে হাজার হাজার ব্যাটারি রিকশার প্রতাপ দেখা গেছে। আন্দরকিল্লা মোড়, সিরাজউদৌল্লা রোড, বাকলিয়া, কালামিয়া বাজার, হালিশহর, বড়পুল, অলংকার মোড়, একে খানসহ বিভিন্ন এলাকায় দিনভর যাত্রী নিয়ে ব্যাটারি রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনটি ইতোমধ্যে অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ চাইলে একদিনেই অবৈধ ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করতে পারে মন্তব্য করে পারভেজ আহমেদ বলেন, পুলিশ যদি চলতে না দেয় তাহলে কাল সকাল থেকে কী নগরীতে একটি ব্যাটারি রিকশা চলতে পারবে?
গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করে সিএমপি। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে পুলিশের জোরালো অভিযান ছিল না। এতে সড়ক ছেড়ে যেতে হয়নি রিকশাগুলোকে। গত ১৮ এপ্রিল নগরীর কাপাসগোলা এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে খালে রিকশা পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়। তখন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন নগরীতে ব্যাটারি রিকশা চলাচলের বিরুদ্ধে সরব হন।
এ অবস্থায় এপ্রিলে নগরে রিকশার ব্যাটারি চার্জ করার পয়েন্টগুলোতে এবং সড়কে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে রিকশা উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়। এ সময় বিভিন্ন গ্যারেজে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়েও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। জব্দ করা হয় কয়েক হাজার রিকশা ও ব্যাটারি।
এর প্রতিবাদে রিকশা চালকদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছিল। এরপর নগরীর মূল সড়কগুলোতে ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য কিছুটা কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে আবার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে পুলিশ গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করল।
ব্যাটারি রিকশা বন্ধের পক্ষে যেমন জোরালো দাবি উঠছে তেমনি কেউ কেউ এটিকে শৃক্সখলার মাঝে আনারও পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন, ব্যাটারি রিকশা নগরবাসীর গুরুত্বপূর্ণ একটি বাহনে পরিণত হয়েছে। এই রিকশা নগরীতে সিএনজি টেক্সি চালকদের ভাড়া নৈরাজ্য কমিয়েছে। ব্যাটারি রিকশা বন্ধ হলে সিএনজি টেক্সিগুলো যে পরিমাণ ভাড়া হাঁকাবে তাতে নগরবাসীর অনেকেরই পথে নামা কষ্টকর হবে। বর্তমানে সিএনজি টেক্সি যে দূরত্বের জন্য দেড়শ টাকা ভাড়া চায়, ব্যাটারি রিকশা সেখানে ৪০–৫০ টাকায় নিয়ে যায়। এতে অনেকে উপকৃত হন। তবে তারা পুরো সেক্টরটিকে একটি নীতিমালার আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রথমে এটির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মূল সড়কে উঠতে পারবে না। প্রতিটি রিকশার রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে। ট্যাক্স নিতে হবে। ড্রাইভারের প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স থাকতে হবে। ব্যাটারি রিকশাকে যদি একটি সিস্টেমে আনা যায় তাহলে সরকার এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে পারবে। প্রশিক্ষিত চালক দ্বারা পরিচালিত হলে ঝুঁকিও বহুলাংশে কমে যাবে বলে খোকনুজ্জামান শাহেদ নামে লালখান বাজারের একজন বাসিন্দা মত প্রকাশ করেন।
ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাটারি রিকশা অবৈধ। মাননীয় পুলিশ কমিশনার ইতোমধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। আমরা এই রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান আরো জোরদার করব। নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য এই রিকশা বড় হুমকি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরা রাস্তাজুড়ে বিশৃক্সখলা তৈরি করে, ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ একটি বাহনকে নগরীতে চলতে দেওয়া যায় না।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিষয়টি পুলিশের। পুলিশ কমিশনার সাহেব একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছেন। তিনিই বিষয়টি দেখছেন। নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, রাস্তার শৃক্সখলা দেখার বিষয়টি পুরোপুরি উনার এক্তিয়ার। সেখানে আমার কিছু বলার নেই।
তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনার সাহেবের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ব্যাটারি রিকশার সাথে জড়িত লোকজন আমার কাছে এসেছিল। আমি তাদের এই কথা বলে দিয়েছি। তাদেরকে গলির ভিতরে থাকতে বলেছিলাম, তারা সেটা পারেনি। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ যাতে রিকশা না চালায় সেটা বলেছিলাম। সেটাও তারা রক্ষা করেনি। অ্যাকসিডেন্টের সংখ্যা কমিয়ে আনতে বলেছিলাম, সেটাও পারেনি। তারা আমার কোনো কথাই রাখতে পারেনি।
সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ আজাদীকে বলেন, আমরা গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছি মানুষকে সচেতন করতে। এটি ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাহন চলতে পারে না। এটা সড়কে বিশৃক্সখলা করে, বিদ্যুৎ সেক্টরে সংকটের সৃষ্টি করে। দুর্ঘটনা ঘটায়। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। তাই ব্যাটারি রিকশা আর চলতে দেওয়া হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অলিগলি বলে কিছু নেই। চট্টগ্রাম মহানগরীর কোথাও ব্যাটারি রিকশা চলবে না। এটাই শেষ কথা।