দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি ১১ জেলাতেই সীমাবদ্ধ আছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে বেড়েছে বানভাসির সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৮। গতকাল শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টিই আছে। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮টি। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে–এ রকম পূর্বাভাস আমরা পেয়েছি। এই সময়ে হবিগঞ্জ মৌলভীবাজারের মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, উত্তর–পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানির সমতল হ্রাস অব্যাহত আছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এদিকে উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, পানি কমে তার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এরই মধ্যে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
উজানের ঢল আর ভারী বর্ষণে গত কয়েকদিন ধরে ভাসছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কঙবাজার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের বরাতে আলী রেজা বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এই সময়ে এই অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ফেনী, গোমতী, হালদা এই নদীগুলোর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৮ জন মারা গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আগে ছিল ১৩ জন। এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা গেছে ১৮ জন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে ১ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন, চট্টগ্রামে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১জন ও কঙবাজারে ৩ জন।
বন্যার্তদের জন্য ফেনীতে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব রেজা বলেন, সেটি সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্জন কার্যালয় সমন্বিতভাবে পরিচালনা করবে। যারা বন্যাপীড়িত তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মোট ৩৫২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, আশ্রিত লোক ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৮ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে ২১ হাজার ৬৯৫টি গবাদি পশু নিয়ে আসা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী জেলায় যে বন্যা কার্যক্রম আছে; নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, ছাত্র প্রতিনিধিগণ, বিজিবি সবাই জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করছেন। তিনি জানান, বন্যাদুর্গত ১১ জেলায় মোট ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ১৫০ টন। এছাড়া ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। শিশুদের খাবারের জন্য ৩৫ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য কেনার জন্য ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কোন নদী বিপৎসীমার কত উপরে : গতকাল সকাল ৯টায় দেশের ৬টি নদীর পানি ৯টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছিল। ওই সময় বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের ১১৬টি স্টেশনের মধ্যে ২২টি পয়েন্টে পানি বাড়ার প্রবণতা দেখা গেলও কমছিল ৮৪ পয়েন্টে আর অপরিবর্তিত ছিল ৪ পয়েন্টে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৯টায় কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। খোয়াই নদীর পানি হবিগঞ্জের বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর মৌলভীবাজার পয়েন্টে মনু নদীর পানি বিপৎসীমার ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল।
চট্টগ্রামের রামগড় স্টেশনে ফেনী নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। সকালে কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের অমরশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, আর শেওলা পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার এবং শেরপুর–সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুনামগঞ্জের মারকুলী পয়েন্টে এই নদীর পানি বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল। আর ফেনীর পরশুরাম স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানকার মুহুরী নদীর বিষয়ে তথ্য দিতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে, ৩ বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস : উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, পানি কমে তার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এরই মধ্যে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীর পানি কমার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনীর সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এবং ভারতের ত্রিপুরায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি এবং উজানের নদ–নদীর পানি কমার প্রবণতা অব্যাহত আছে। ফলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতি শুক্রবার থেকে উন্নতি হচ্ছে এবং অব্যাহত আছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর–পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময়ে দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানেও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে।
বুলেটিনে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র–যমুনা নদীর পানি কমছে, অন্যদিকে গঙ্গা–পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। এ অবস্থা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সুরমা–কুশিয়ারা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজ করছে, যা ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
দুদিনের ভারী বৃষ্টির সতর্কতা : পানি কমতে থাকায় দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে, পূর্বাভাস কেন্দ্রের এমন বার্তার মধ্যেই আরও দুদিন তিন বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল সন্ধ্যায় আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪–৮৮ মিলিমিটার/২৪ ঘণ্টা) বৃষ্টি হতে পারে। ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমি ধস হতে পারে।
গোমতী বাঁধের ভাঙন বাড়ছে : ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে বুড়িচং উপজেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় পরিবারের সদস্যদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনরা। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে ও ভেঙে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় পানিবন্দিদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীসহ সমাজিক সংগঠনগুলো কাজ করছেন।
মৌলভীবাজারে ৯ হাজার মানুষকে উদ্ধার সেনাবাহিনীর : মৌলভীবাজারে বন্যা দুর্গত এলাকা থেকে প্রায় নয় হাজার মানুষকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এছাড়া উদ্ধার কাজে অংশ নেন স্থানীয় প্রশাসন, ছাত্র সমন্বয়ক ও স্বেচ্ছাসেবীরা।