বাংলাদেশের কর্পোরেট প্রেক্ষাপটে একটি প্রচলিত অথচ তীব্র ব্যঞ্জনাময় কৌতুক রয়েছে: এক চোর কোনো বাড়িতে প্রবেশ করে মূল্যবান কিছু না পেয়ে কেবল সময়ক্ষেপণের জন্য একটি ধন্যবাদ জ্ঞাপক চিরকুট রেখে যায়। এই উপকথাটি আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার এক সরলীকরণ হতে পারে; কিন্তু বর্তমানের কর্পোরেট লুণ্ঠনকারীরা সেই সরল চোরের চেয়ে অনেক বেশি ‘বুদ্ধিমান’। তারা এখন আর কেবল ‘ধন্যবাদ’ জ্ঞাপন করে না, বরং নীরবে দেশের সম্পদ ও সামগ্রিক অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে চলেছে।
আজকের কর্পোরেট লুণ্ঠনকারীরা ঐতিহ্যগতভাবে কেবল ব্যক্তিগত সম্পদ চুরি করে না; তারা মূলত কাঠামোগত ত্রুটি, নিয়ন্ত্রক শিথিলতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাকে হাতিয়ার করে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছে। পুঁজি পাচার এখন সম্পদ পাচারের একটি প্রধান মাধ্যম, যেখানে বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন আর্থিক কারসাজির মাধ্যমে দেশের বাইরে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করে। এই নীরব লুণ্ঠন দেশের প্রবৃদ্ধি এবং সাধারণ নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি বাধা সৃষ্টি করছে। সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যা সামাজিক–অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও গভীর করে তুলছে। এটি নৈতিকতার এক চরম অভাবের পরিচায়ক। এই লুণ্ঠন কেবল দেশের কোষাগারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক আর্থ–সামাজিক কাঠামোর ওপর।
বৈষম্য বৃদ্ধি: কর্পোরেট লুণ্ঠনের ফলে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়, যা আয়ের বৈষম্যকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বাধা: দেশের পুঁজি অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ায়, দেশীয় অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের জন্য তহবিলের অভাব দেখা দেয়। এর ফলে নতুন শিল্প স্থাপন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হয়, যা যুব সমাজের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
জনকল্যাণমূলক খাতে আঘাত: সরকারি রাজস্বের একটি অংশ লুণ্ঠনের শিকার হওয়ায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো জনকল্যাণমূলক খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ থেকে রাষ্ট্র বঞ্চিত হয়।
এই নীরব লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজন মৌলিক নীতিগত সংস্কার এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর কঠোর প্রয়োগ। এই সমস্যার মূলে যে কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে, তা দূর করতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলি আবশ্যক:
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: সকল বৃহৎ কর্পোরেট লেনদেন এবং সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বের চুক্তিগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে উচ্চতর স্বচ্ছতার মানদণ্ডের আওতায় আনতে হবে। কর্পোরেট দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে একটি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা: বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন–এর মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে।
পুঁজি পাচার প্রতিরোধ: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে, ‘ট্রেড–বেজড মানি লন্ডারিং’ (বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার) শনাক্ত করার জন্য কাস্টমস ও বন্দরের নজরদারি আধুনিকীকরণ করা অপরিহার্য। এই নীরব লুণ্ঠন শুধু একটি আর্থিক অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর একটি সরাসরি আঘাত, যা কার্যত অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের সমতুল্য। এই প্রেক্ষাপটে, প্রয়োজন সামগ্রিক প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি বিবেচনা করে একটি যুগোপযোগী ও কঠোর পদক্ষেপ। কেবল লোক দেখানো সংস্কার নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগই পারে এই নীরব লুণ্ঠনকে থামিয়ে দিতে। এই প্রবণতা বন্ধে দ্রুত, কঠোর এবং মৌলিক নীতি সংস্কার এখন সময়ের দাবি।












