অর্থনৈতিক খাতগুলোকে আরও উন্মুক্ত ও সক্রিয় করতে হবে

| শুক্রবার , ৯ মে, ২০২৫ at ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বব্যাংকের সামপ্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক গতি কমে যাওয়া, পণ্যের দাম বাড়া এবং চাকরি হারানোর ফলে লাখো মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়তে পারে, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৪ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। স্বল্প দক্ষ কর্মীদের মজুরি কমেছে ২ শতাংশ এবং উচ্চ দক্ষদের আয়ও সামান্য হ্রাস পেয়েছে। এর মানে, কাজ হারানোর পাশাপাশি যাঁরা এখনো কাজ করছেন, তাঁরাও আগের চেয়ে কম আয় পাচ্ছেন। এতে করে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। গত বছর যেখানে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছর শেষে তা বেড়ে হতে পারে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, জাতীয় পর্যায়ের দারিদ্র্যও কমছে না। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। দেশের জনসংখ্যা যদি ১৭ কোটি ধরা হয়, তাহলে নতুন হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকবে, আর মোট দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ কোটি ৯০ লাখের মতো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে এ দেশে ৮৮ শতাংশ লোক ছিলেন দরিদ্র, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল। ১৯৭২ সালে ৭ কোটি লোকের মধ্যে ৫ কোটি ছিলেন দরিদ্র। ১৯৯১ সালে দরিদ্রের হার ছিল ৪৪.২ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০১০ সালে ১৮.৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৪.৩ শতাংশ, ২০১৮ সালে ২০ শতাংশ, ২০২২ সালে ১৭.৭ শতাংশ এবং অতিদরিদ্র ছিল ৫.৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বিসিএস জরিপে দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিং দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশে সাফল্যের প্রশংসা করে বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের সম্পদ লুট করে সফল হতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের দারিদ্র্য ২০২৩ সালে ৩৭.৯ শতাংশ, ২০২২ সালে ৩৯.২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৫৫ শতাংশ, পাঞ্জাবে ৩২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, পাকিস্তানের দারিদ্র্য ৪.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫.৮ শতাংশ হয়েছে।

অন্যদিকে কিছুদিন আগে জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত অলিভিয়ে ডি শ্যুটার দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করেছে সেটিকে ‘ভঙ্গুর‘ বলে মন্তব্য করেছেন। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হবার পর মজুরি বৃদ্ধি এবং সামাজিক খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে মি. শ্যুটার বলেন, বাংলাদেশের উচিত মজুরি বাড়ানো যেন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সুবিধা পেতে দেশটির জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের মধ্যে রাখতে না হয়। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সামপ্রতিক একটি জরিপে দারিদ্র্য কমে আসার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সামপ্রতিক বছরগুলোয় চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা অনেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে উঠেছে। এর ফলে হঠাৎ কোন বিপদ এলে সেটা মোকাবিলা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। অনেক পরিবার, দারিদ্র্যসীমার ঠিক উপরে উঠে এলেও তাদের টিকে থাকার সামর্থ্য নেই। তাদের অর্থ সঞ্চয় করা বা পুঁজি জমানোর সক্ষমতা নেই। ধাক্কা সামলানোর মতো কোন সম্পদ তাদের নেই। মি. শ্যুটার মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উঠে আসার ধাক্কা সামলাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল পরিবর্তন করা উচিত। রপ্তানি বাড়ানোর চাইতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর দিকেই বেশি নির্ভর করা উচিত এই উন্নয়ন মডেলের। যেটি কিনা চীন করেছে ১৫২০ বছর আগে, যখন তারা স্থানীয়ভাবে মজুরি বাড়াতে শুরু করে। তখন তারা সামাজিক সুরক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার পর বাংলাদেশও এটি করতে পারে এবং করা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা, শারীরিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত জীবন অর্জনের চেষ্টা করা উচিত।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন দ্রুত ও কার্যকরী সংস্কার। এখনই সময় অর্থনৈতিক খাতগুলোকে আরও উন্মুক্ত ও সক্রিয় করার। বাণিজ্য সহজ করতে হবে, কৃষিকে আধুনিক করতে হবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ, দারিদ্র্য কমাতে হলে শুধু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নয়একটি শক্তিশালী, কর্মসংস্থানমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলাই সবচেয়ে জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে