‘অমৃতস্য পুত্রা’ মহিউদ্দীন শাহ আলম নিপু

ড. আকাশ মাহমুদ | বুধবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

২রা আগস্ট ২০২৫ তারিখে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপুর অভাবিত চিরবিদায় ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য এক প্রচণ্ডতম ধাক্কা। তাই হৃদয় আমার বিষাদভারাক্রান্ত। তার সাথে আমার শুধু কালধারার সম্পর্কই একমাত্র নয়। সে আমার অগ্রজ মামাতো ভাই। বয়সে সে বড়ো হলেও আমার অকৃত্রিম বন্ধু এবং বন্ধুদের মধ্যে প্রধানতম। আকৈশোর আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। তবে আত্মীয়তাসূত্রেরও অধিক ব্যঞ্জনা আমাদের দুজনের সম্পর্কে। নিপুর এই আকস্মিক চিরবিদায় তাই হৃদয়বিদারক।

বাস্তবতা এই যে, চট্টগ্রামের সাহিত্যিকসাংস্কৃতিকপ্রকাশনাসমাজে তার মৃত্যু এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করেছে রবং অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। নিপু এই জগতটাতে একাই একটা ‘প্রতিষ্ঠান’ ছিল। এজন্য বিশেষ করে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পে পড়বে সুগভীর প্রভাব। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনাসহ লেখক তৈরিতে নিপুর অবদান অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। একসময় নিপু “রিস্ক” নিয়েও ব্যতিক্রমি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে এবং সরকারি ঝামেলায়ও পড়েছিল। সেসব বর্ণিল ইতিহাস। এজন্যই আরো অনেকদিন আমাদের শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতিপ্রকাশনায় তার এরকম ভূমিকা ও অবদান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমৃত্যু আমার জীবনের পরম হিতৈষী, সুহৃদ, আকৈশোর বন্ধু ও নিকটাত্মীয় নিপুর এই তিরোধান কোনোভাবেই কখনোই পূরণ হবে না।

স্কুল ও কলেজবেলায় আমরা দুজন ছিলাম চট্টগ্রামের দুপ্রান্তে নিপু শহরে আর আমি গ্রামে। ও ছিল কলেজিয়েট স্কুলে এবং চট্টগ্রাম কলেজে আর আমি মিরসরাই হাইস্কুলে ও নিজামপুর কলেজে। নিপুর জন্ম ও আকৈশোর বেড়ে ওঠা ছিল শহরকেন্দ্রিক। স্বাভাবিকভাবেই শহুরে জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত, সরলজটিল অভিজ্ঞতায় সে ছিল স্নাত ও ঋদ্ধ। উনিশ শো বাহাত্তর পর্যন্ত আমরা ছিলাম বাস্তবিকই দুপ্রান্তের বাসিন্দা। সুতরাং যাপিতজীবনসূত্রে সৃজিত ও জারিত ভাবজগতের প্রেক্ষাপটে আমাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল এক নিরেট বাস্তব। তবুও এই দূরত্বকে হটিয়ে দিয়ে কীভাবে যেন আমরা বন্ধুত্বের অচ্ছেদ্য বাঁধনে চিরকালের জন্যে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। একথা অনস্বীকার্য যে, সাহিত্যসংস্কৃতির জগতে ১৯৭২ সালে আমার লাজুক প্রবেশ, ক্রমবিকশিত হওয়া এবং বর্তমান সরব বিচরণের নেপথ্যে নিপু এক অনিবার্য অনুঘটক। প্রকৃতপক্ষে, নিপু না থাকলে সাহিত্যসংস্কৃতির ঐশীজগতে প্রবেশসোপানের প্রথম ধাপও পেরুতে পারতাম কিনা সন্দেহ।

গ্রামের বাড়ির বাহ্যিক ও আন্দরিক পরিবেশে আমার সৌন্দর্য ও সাহিত্যপিপাসু মন আর ভাবজগত তৈরি হয়েছিল। তবে বিকাশের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। আমার সে গোপন স্পৃহা ও মনোজগত প্রকাশক মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল চট্টগ্রামে এবং বিশেষত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। নিপুর আন্তরিক প্রেরণা ও অবিরল প্রচেষ্টা ছিল এর প্রকৃত নিয়ামক। সেই যে তার হাত ধরে অন্তর্জাত সাহিত্যএষণার আকস্মিক প্রকাশ ঘটেছিল আজও এই সুবিশাল ভুবনে আমি সামনে আগুয়ান। সে সময়ে ঝাঁকেঝাঁকে বিচিত্র তারুণ্য আর বিশ্বজ্ঞানের ভাণ্ডারের বিশালতায় বিস্মিত, বিচলিত আর বিমুগ্ধ সেই দূর গ্রাম থেকে আসা এক যুবককে পাশে নিয়ে নিত্যদিন বরাভয় আর অভিযোজনের দেশনা দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল নিপুই।

নিপুর নিবেদন প্রেস প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। প্রেসের নামটিও আমার দেওয়া। নিবেদন প্রেসকে কেন্দ্র করে চাটগাঁর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ভুবনে ভিন্নতর একটা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। কালান্তরে নিবেদন প্রেস আর নিপু বিদিত তার অনন্য ভূমিকায়। সেটি ছিল আমার চট্টগ্রামবাসকালের প্রধান আড্ডাস্থল, কালধারা প্রতিষ্ঠার সূতিকাগার, কালধারার সকল কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা ও পরিচালনার পীঠস্থান, কালধারা পরিবারের মিলনকুঞ্জ। নিবেদন প্রেসকে কেন্দ্র করে একটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ ও সাহিত্যসংগঠন পরিচালনার বিষয়ে সার্বিক দায়িত্বগ্রহণে ও পরিচালনায় আর নেতৃত্ব প্রদানে তার তাৎক্ষণিক দ্বিধাহীন সাহসী সিদ্ধান্তের ফলই বিগত অনেকগুলো বছর ধরে কালধারার দৃঢ়পদে পথচলা, সাবলীল অগ্রযাত্রা ও যাবতীয় কর্মকীর্তি। নিপু ছিল কালধারার ছায়াদায়ী মহীরূহ আর কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণার অপরিমেয় উৎস। নিপু, নিবেদন প্রেস আর কালধারা একই সুতোয় বাঁধা। আমার প্রথম গ্রন্থের মুদ্রক ও প্রকাশক এবং পিএইচডি অভিসন্দর্ভের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকারক নিপু ও নিবেদন; এসব কাজ নিপু কোনো দ্বিধা না রেখেই পরমাগ্রহে করে দিত। সবসময়েই বিস্মিত হয়ে ভাবতাম এই দেখে যে নিপু শুধু আমার নয়, চেনা অচেনা সকলেরই এই ধরনের এবং নানাবিধ প্রকাশনার কাজ বস্তুবাদী ভাবনাকে একপাশে ঠেলে রেখে করে দেয়। এই ঔদার্য নিপুর সহজাত। তবে নাসরিন ভাবির ভাষায়, “তিনি এক অতি উদার ব্যবসায়ী!”

এ প্রসঙ্গে প্রয়াত কবিসাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তের মন্তব্য এরকম,“নিপু ভাই মুদ্রণব্যবসাকে তাঁর জীবিকা করেছেন। কিন্তু জীবিকার চেয়ে উপজীবিকাই যেন তাঁর কাছে বড়ো।” এই উপজীবিকা কী? তা হলো সাহিত্যসংস্কৃতিপ্রকাশনার মাধ্যমে মূলত চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশের জন্য নিপুর নির্দ্বিধায় নিরন্তর নিরলস লেগে থাকা। ছাপাখানার ব্যবসা ছিল তার কাছে অনেকটাই গৌণ বিষয়। এই কাজটি নিপু আমৃত্যু করে গেছে। ফলে অন্য অনেক প্রেস ও প্রকাশনা ব্যবসায়ীর মতো তার জীবন থলেতে অর্থকড়ির ঝনঝনানি ছিল না। কিন্তু ঝলমলে টইটম্বুর ছিল তার সৃজনশীল চিন্তার ও কর্মের জীবনক্ষেত্র। অরুণদাদা যথার্থই বলেছেন, “নিপু ভাই উপার্জনের দিকটাকেই অর্জনের দিকে নিয়ে গেছেন এবং সেক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য বিশিষ্টতা অর্জনে।” এই বস্তুবাদী সমাজে এরকম একজন মানুষ প্রকৃতই বিরলপ্রজ। একই কথার প্রতিধ্বনি পাই কবি স্বপন দত্তের মূল্যায়নে, “প্রেসব্যবসাকে কেবল ব্যবসা হিসেবে না নিয়ে মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু যে সেখানে ‘কালধারা’র মতো একটি অলাভজনক সাহিত্যপত্রকে লালন করে গেছেন, এই কাজ তাঁকে আগামী দিনগুলোেেত স্মরণীয় করে রাখবে”।

নিপু সম্পর্কে আমার শিক্ষক প্রয়াত ড. মনিরুজ্জামানের মন্তব্য এবং মূল্যায়নও প্রণিধানযোগ্য: নিপুর “কর্মস্পৃহা ও সচল গতিময় (ডায়ানামিক) জীবন রীতিমত ঈর্ষণীয়।” প্রকাশনাশিল্পে নিপুর “বলিষ্ঠ পদচারণার” ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় এক “মাইলস্টোন” যার “কালজয়ী নাম কালধারা”। তাঁর ভাষায়, “শাহ আলম সত্যকামী। তবে প্রতিষ্ঠার চেয়ে কর্মব্যাপ্তিই তার লক্ষ্য”। তাই তাঁর কাছে “সাধারণ মানুষের ভাবনা চিন্তার দিক থেকে” “নিপুকে ব্যতিক্রমই” মনে হয়েছে । তাই তাঁর দৃঢ় এবং সোচ্চার কণ্ঠের উচ্চারণ: “নিপুর বিপুল আয়োজন, নিপুর সৎ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রসারে তাঁর স্বার্থবোধশূন্য ও বাণিজ্যিকরহিত বহুমুখী দৃষ্টিবহুল কর্মতৎপরতা এবং বন্ধুবাৎসল্যযুক্ত অশেষ সাহিত্যপ্রীতি আজকের সাহিত্যমরু সমাজে যে কতখানি প্রয়োজন ও কতবড় আশীর্বাদ স্বরূপ প্রাপ্তি , আগামী সমাজ হয়ত নিত্যই তা অনুভব করবে।”

দীর্ঘ দীর্ঘ দিন ধরে খুবই কাছ থেকে নিত্য নিপুকে আমি দেখেছি একজন বন্ধুবৎসল, মিতবাক, স্মিতবাক, বিনম্রচিত্ত, সদাহাস্য, রুচিশীল, সহজাত পরিশ্রমী, সৃজনশীল ও সংস্কৃতিমনা, সাহিত্যসেবী, দক্ষ সংগঠক, পরোপকারী, সহজসরল, অত্যন্ত সামাজিক ও একান্তই সজ্জনব্যক্তিরূপে। বিশেষত, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ সম্ভবত তারই সবচেয়ে বেশি। অকুণ্ঠচিত্তেই বলা যায়, যথার্থ নিষ্ঠার সাথেই সে কাজটি করে থাকে যা আমাদের অনেকের মধ্যে সত্যিই অনুপস্থিত। নিপুর এই অভ্যাস প্রসঙ্গে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এর প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ক্বামার বানু নিপুর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে মন্তব্য করেছেন: সমাজমানুষের প্রতি নিপুর মতো দায়িত্ববোধ বিরলদৃষ্ট।

নিপু আজ এই ধরাধামে নেই। নেই মননশীলতার, সৃজনশীলতার কর্ষণ ও চারণভূমি প্রিয় চট্টগ্রামে, নিবেদন প্রেসের দপ্তরে, প্রকাশনার পরিকল্পনার ব্যস্ততায় অথবা কালধারার আড্ডায়। নিপু থাকবে না আগামী বইমেলার আয়োজনে বা কোনো প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কিংবা সাহিত্যসভায়। কিন্তু আমরা তার অনুপস্থিতি আর অভাব অনুভব করতেই থাকব। স্মরণসূত্রে নিপু থাকবে সৃজনপিপাসু মানুষদের মনে চিরকাল তাজা।

নিপুর প্রয়াণে তারই হাতে গঠিত ও লালিত সংগঠন কালধারা আয়োজিত এই সভায় গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করি কৃতীমান নিপুকে, তার যাবতীয় কীর্তিকে। মানুষেরাই ‘অমৃতস্য পুত্রা’সুপ্রাচীন বৈদিকসাহিত্য ঋগ্বেদসংহিতার এই অমরবাণীটি মনে করে অকুণ্ঠচিত্তে বলি নিপুও ছিল অসাধারণ এক অমৃতের পুত্র। নিপুও অবিরল দান করে গেছে অঢেল অমৃতসুধা আমাদের জন্যে, সাহিত্যতৃষ্ণাহীন এই সমাজের জন্যে আর সাহিত্যসংস্কৃতিপিপাসু মানুষদের জন্যে। অবিচল একাগ্র নিষ্ঠায় এই নশ্বর জীবনে প্রতিদিন রচনা করে গেছে আমাদেরই প্রতিশ্রুতিশীল সৃজনশীল নবীন প্রজন্মের জন্য এক সুন্দর আগামী।

নিপুর কৃতি ও কীর্তিকে স্মরণযোগ্য করে তুলতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন ও কিছু প্রস্তাবনা নিম্নরূপ:

ক। সাহিত্যসংস্কৃতির বিকাশে নিরলস ও আন্তরিক ভূমিকা ও অবদান রাখার জন্য নিবেদন প্রেসকে চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান;

খ। সাহিত্যসংস্কৃতিতে আমৃত্যু তাঁর বহুমুখী ভূমিকা ও অসাধারণ অবদানের জন্য আসন্ন ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপুকে “একুশে পদক ও সম্মাননা” প্রদান;

গ। “কালধারা’’ সাহিত্যপত্র, “কালধারা’’ কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান আয়োজন এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কর্মযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে “কালধারা পরিষদ”কে চট্টগ্রামের একটি প্রভাবশালী সাহিত্যসাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে মর্যাদা প্রদান; এবং

ঘ। মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপুর জীবন, কর্ম, অবদান, কৃতি ও কীর্তিবিষয়ক একটি স্মারকগ্রন্থ ও তার গ্রন্থিতঅগ্রন্থিত রচনাবলি প্রকাশ এবং ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করার উদ্যোগ গ্রহণ।

(গত ২১ আগস্ট ২০২৫ কালধারা আয়োজিত মহিউদ্দীন শাহ আলম নিপুর স্মরণসভায় প্রদত্ত বক্তব্যের ঈষৎ পরিমার্জিত রূপ।)

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। সাবেক অধ্যক্ষ, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ