মরনের ফুল বড় হয়ে ফোটে জীবনের উদ্যানে…
: কবি মোহিত লাল মজুমদারের কথাটি যেন সত্য প্রমাণ করলেন অমলেন্দু বড়ুয়া। ফুল নিজের জন্য ফোটেনা। সবাইকে মুগ্ধ করার জন্য, সবার কাছে সৌরভ বিলানোর জন্য তার ফোটা। তাঁর সেই অভিযাত্রা আমাদের ব্যথিত করে, শোকাবিভূত করে। তাঁকে হারিয়ে আমাদের অন্তর কেবল ধ্বনিত হচ্ছে-
”রাজ্য তারে রাখিল না,
প্রিয়া তারে ছেড়ে দিল পথ,
রোধিলনা সমুদ্র পর্বত।”
যাঁর আলোকদীপ্ত উপস্থিতিতে আমাদের শিক্ষা-সাহিত্য, সমাজ সংস্কৃতি সতত সমুজ্জ্বল থাকতো, যাঁর স্নিগ্ধ স্পর্শে আনন্দ মুখর হয়ে উঠতো সমগ্র পরিবেশ। সেই উজ্জ্বল ধুমকেতুর অকস্মাৎ নিভে যাওয়া সত্যিই বেদনা-দায়ক। জন্ম, জরা ব্যাধি-মৃত্যু চিরদুঃখ বিভীষিকাময় এই জগত সংসারে-জন্মমৃত্যু হলো কঠিন বাসতবতা “জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে”।
জন্ম মৃত্যুর রহস্যঘেরা এই পৃথিবীতে কতো ফুল অকালে ঝরে যায়। কতো দীপ্তিমান আলোকবর্তিকা অন্ধকারে হারিয়ে যায়। কবি সুকান্ত, বিপ্লবী রোহিনী, ক্ষুদিরাম আরো কত অসম্ভব সম্ভাবনা অকালে হারিয়ে গেল। ১৯৯৯ খৃস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি ভোরে হঠাৎ অকালেই অমলেন্দু বড়ুয়ার অন্তর্ধান ঘটলো। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল সেইদিন মানুষের অন্তিম ভালোবাসায়।
লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলী ঢেউয়ের তালে নৃত্য-ছন্দে, আষাঢ়ের গর্জনে, শ্রাবণের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে গড়ে উঠেছে সবুজ শ্যামলিমা ঘেরা একটি জনপদ কত দূর খীল বিশাল বিসতীর্ণ অনাবাদী এলাকা। মুক্তিসংগ্রামের দৃশ্যমান কালুরঘাটের পূর্বপ্রান্তে মনোরম নিরিবিলি গ্রাম কধুরখীল। সেই জনপদের বৌদ্ধ পল্লীতে জন্ম নিয়েছেন ডাঃ বীরেন্দ্র লাল বড়ুয়ার মতো মনীষী, জন্ম নিয়েছেন প্রতিথযশা সাংবাদিক সাহিত্যিক বিমলেন্দু বড়ুয়া, আরো অনেক খ্যাতকীর্তি ব্যক্তিবর্গ। এমন স্বনামধন্য গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে পিতা প্রিয়নাথের বড়ুয়া ও মাতা বিধুমুখী বড়ুয়ার ঘর আলোকিত করে জন্ম নিল এক শিশু। সেই শিশু জাগিয়ে তুললো কর্ণফুলীর আওয়াজকে। যেন গেয়ে উঠলো আজি তোরা আজি তোরা কে কোথায়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।” ১৯৪৬ খৃস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি, ১৩৫১ বাংলার ১৯ পৌষ, বুধবার গর্বিত পিতা-মাতার ঘরে জন্মগ্রহণকারী সেই শিশুটির নাম অমলেন্দু বড়ুয়া। সংসারে আনন্দের সীমা নেই। সেই সম্ভাবনাময় শিশুটি বড় হতে লাগলো। যথাসময়ে হাতেখড়ি দেয়া হল। শিক্ষা জীবনের শুরু কধুরখীল প্রাইমারী স্কুলে। মাতুলালয় ছিল নিজগ্রামে ডা: বীরেন্দ্র লাল বড়ুয়ার বাড়ী। সাথী ছিল মামাতো ভাই সুভাষ, কাছাকাছি বয়স- ছোটাছুটি, দৌড়-ঝাঁপ, পুকুরে সাঁতার বৃষ্টিতে ভেজার মহাআনন্দ, ফুটবল, চড়ুইভাতি, গাছে উঠা আমকুড়ানো, হৈ-চৈ। মাতুলালয়ে কাটতো অধিকাংশ সময়। স্নেহ-মমতা, যত্ন ভালোবাসা পেয়েছে সকলের।
অমলেন্দু পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। বড় ভাই বিমলেন্দু, বড় বোন লিলি এবং অনুজ নীহারেন্দু। তাঁরা তিন উচ্চ শিক্ষিত ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। বড়ভাই বিমলেন্দু বড়ুয়া পেশাগতভাবে বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদীর প্রধান সহ-সম্পাদক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধদের জাতীয় সংস্থা বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি। ছোট ভাই নীহারেন্দু বড়ুয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও প্রচার সংঘের অন্যতম কর্মকর্তা হিসাবে খ্যাতিমান।
অমলেন্দু বড়ুয়া ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন, ছবি আঁকতেন, নরোম মাটি দিয়ে গড়ে তুলতো ভাষ্কর্য। কলমে ফুটে উঠতো সাহিত্যের ভাবধারা। বড় ভাই বিমলেন্দু বড়ুয়া সাহিত্য চর্চা করেন। ছোট ভাই অমলেন্দুর মধ্যে সাহিত্য প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হলেন। ১৯৬১ সনে কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অমলেন্দু বড়ুয়া কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলেন। সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ দেখে শিক্ষকরা মন্তব্য করলেন, “বড় হয়ে একদিন এই ছেলে খ্যাতনামা সাহিত্যিক হবে।” কবিতার প্রতি গভীর মমতা আর আবৃত্তিতে মুগ্ধ করতেন সকলকে। পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (১৯৬৬), চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক (১৯৬৯), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (১৯৭৬) ডিগ্রী লাভ। শিক্ষকতা জীবনে এসে চট্টগ্রাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বি.এড (১৯৮৫) ডিগ্রী লাভের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করলেন তাঁর মেধাকে।
শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অমলেন্দু বড়ুয়া মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষাব্রতী, শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী হিসেবে আপন ভুবনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় পটিয়াস্থ হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, হাবিলাসদ্বীপে ছিলেন। কিছুকাল চট্টগ্রাম শহরস্থ মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে, পতেঙ্গাস্থ বি.এফ শাহীন স্কুলে, বোয়ালখালীস্থ আজগর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে, ঢাকাস্থ মতিঝিলের আইডিয়াল হাইস্কুলে, পটিয়ার এ এস. রাহাত আলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে, হাটহাজারীস্থ কুয়াইশ বুড়িশ্চর কলেজে, ঢাকাস্থ ধর্মরাজিক অনাথালয় (আবাসিক) উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে এবং চান্দগাঁওস্থ সানোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করে দেশ ও জাতির কল্যাণে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। নৈশকালীন জে.এম.সেন কলেজও কিছুকাল শিক্ষকতা করেছেন। একজন যোগ্য আদর্শ শিক্ষক হিসেবে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে গড়ে তুলেছেন। যারা আজ সমাজ গগনে সুপ্রতিষ্ঠিত। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বাংলার পরীক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুপরিচিতি ছিল। সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে ছিল যথেষ্ট অনুরাগ ও দক্ষতা। অমলেন্দু বড়ুয়া ছিলেন ৬ষ্ঠ থেকে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত তার উপযোগী বাংলা ও ইংরেজি ২য় পত্রের পাঠ্য বই রচয়িতা।
পটিয়াস্থ এ.এস.রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন ১৯৮৪ সালের প্রথমদিকে খেলাঘর শাখা প্রতিষ্ঠার সাথে অমলেন্দু বড়ুয়ার নামটি জড়িয়ে আছে। ১৯৮৪ সালের ২০ জানুয়ারি বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে শিশু কিশোর সমাবেশ ও নতুন শাখা আসর গঠনের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছোট্টসোনামনিদের সমাগম ছিল উল্লেখ করার মতো। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সংগঠিত করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “বর্ণরেখা খেলাঘর আসর”। বর্ণরেখা নামটি তাঁরই দেয়া। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে থেকে সংগঠনকে গতিশীল করতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমী মিলনায়তনে খেলাঘর জাতীয় সম্মেলনে অমলেন্দু বড়ুয়ার অভিভাবকত্বে বর্ণরেখার সংগঠক ও ক্ষুদে সদস্যরা অংশগ্রহণ করে। খ্যাতিমান গবেষক ও জনপ্রিয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এ সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন।
শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত থেকে সমাজের কল্যাণে বিভিন্নভাবে অবদান রেখে গেছেন অমলেন্দু বড়ুয়া। বিশেষ করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সেবামূলক, ধর্মীয়, শিশু সংগঠন ইত্যাদির সাথে জড়িত থেকে প্রভূতভাবে সমাজ, দেশ সদ্ধর্ম ও জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ যুব-এর উর্ধ্বতন সহ-সভাপতি ও পরে সভাপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ যুব-এর শিক্ষা শিল্প ও সাহিত্যের স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে বিশ্ব দরবারে তিনি কাজ করে গেছেন। সেই সাথে বাংলাদেশ বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ যুব এর সদস্যভূক্ত সংগঠন গুলোকে নিয়ে ফেডারেশন প্রতিষ্ঠায় ”ন্যাশনাল ফেডারেশন অব দি ডব্লিউএফ.বি.ওয়াই রিজিওন্যাল সেন্টার’স ইন বাংলাদেশ” গঠনে অমলেন্দু বড়ুয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পটিয়াস্থ বর্ণরেখা খেলাঘরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে কধুরখীলস্থ জ্ঞানোদয় বৌদ্ধ সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি হিসেবে শিশু-কিশোর-যুবকদের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। খেলাঘর চট্টগা্রম দক্ষিণ জেলা কমিটির সভাপতি ও খেলাঘর জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় ও শিশু সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তেমনি বহুসচেতন যুব সমাজকে সমাজ গড়ার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মুখপত্র “কৃষ্টি” এর সম্পাদনা পরিষদের সদস্য থেকে কৃষ্টির অগ্রযাত্রাকে করেছেন সমৃদ্ধ। “নব সমতট” মাসিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠালয় থেকেই উক্ত পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রায় সবগুলো অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গেছে একজন দক্ষ সংগঠন হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে। সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, পরিশীলিত রুচিময়তা অনুষ্ঠানে পরিচালনায় তাঁর ঐকান্তিক কর্মোদ্দিপনা সকলকে মুগ্ধ ও প্রভাবিত করতো।
অমলেন্দু বড়ুয়ার অনুষ্ঠান উপস্থাপনার ভঙ্গি ছিল আকর্ষণীয়। বাগ্মী হিসেবে তাঁর ছিল যথেষ্ট খ্যাতি। কবিতার ছন্দে বিমোহিত করতেন শ্রোতৃবৃন্দকে। বক্ততার মঞ্চে সুবক্তা হিসেবে সময়োপযোগী কবিতা সংযোজন, সুললিত প্রাঞ্জল ভাষার ব্যবহারে তিনি ছিলেন পারদর্শী, পারঙ্গম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ইত্যাদি যেন মুখের মধ্যে খৈ ফুটতো। এতো সুন্দর সাবলীলভাবে আবৃত্তি করতে পারতেন। অমলেন্দু বড়ুয়া সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর অনুষঙ্গ হিসেবে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতায়, অভিনয়ে, নাট্য পরিচালনায়, বাংলা ও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিতে বিশেষ পুরস্কার লাভের গৌরব অর্জন করেন।
মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর কল্যাণের জন্য অমলেন্দু বড়ুয়া রচনা করেছেন অনেক বই। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণির জন্য ব্যবহারিক ভাষা, ব্যাকরণ ও রচনা, নবম ও দশম শ্রেণির জন্য ব্যবহারিক ভাষা ও রচনা নামক বই প্রণয়ন করে বহু ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার পথকে সুগম করেছেন। এই তিনটি বই ইফতেখার প্রেস ও পাবলিকেশনস প্রকাশ করে। বহু প্রবন্ধ কবিতা ও গল্প লিখতে সাহিত্য সদ্ধর্মকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে, জনসংখ্যা বিষয়ক শিক্ষায়, গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত ছিলেন।
অমলেন্দু বড়ুয়া ছিলেন যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী ও মানব কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। মানুষের উপকারে প্রবৃত্ত মানবিক গুণসম্পন্ন বৌদ্ধ ব্যক্তিত্ব। ছাত্র-ছাত্রীদের স্নেহভালোবাসার মাধ্যমে জ্ঞানদানে ছিলেন সদা সচেষ্ট। আলোচনার টেবিলে ছিলেন প্রাণবন্ত। অমলেন্দু বড়ুয়া ভালোবেসে ছিলেন এদেশের মাটি, আলো, বাতাসকে। জননী জন্মভূমিকে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে তাই তিনি ছুটে যেতেন জন্ম জনপদ কধুরখীল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চীবর দানানুষ্ঠান, নাটক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দেখা যেতো তাঁর সপ্রতিভ উপস্থিতি। তিনি ভালোবাসতেন পিতৃমাতৃহীন অনাথ ছেলেমেয়েদের। অকৃত্রিম স্নেহ মমতা আর মানবতার মূল্যবোধের মাধ্যমে রচনা করতেন সৃষ্টিশীল সৌন্দর্য। কর্মে একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা নিরহংকার, সেবায় মননশীলতা, বন্ধুবৎসল কঠোর পরিশ্রমী এবং সার্থক এক শিল্পী। তুলি ছোঁয়ায় রচনা করতেন সুচারুরূপে নানারূপ শিল্পকর্ম।
অমলেন্দু বড়ুয়া থেমে থাকেননি। বহু প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে তিনি চলে গেলেন পরপারে। মহাপ্রস্থানের ঠিক পাঁ দিন আগে সংঘনায়ক এস.ধর্মপাল মহাথেরর উদ্দেশ্যে লেখা ধর্মপালক ধর্মপাল” কবিতায় অমলেন্দু বড়ুয়ার শেষ প্রণাম।
‘… বহুযুগ ধরে শেকড়ের সন্ধানে আমি / বোধিসত্ত্ব অতীশের জন্মভূমি / নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা তুমি /ধর্মপালের দীঘির কাকাচক্ষুজলে / আমার ঠিকানা খুঁজি সোমপুরী বিহারের ধ্বংসস্তূপে /ময়নামতির শালবনে কিংবা চৈত্যগ্রামে পণ্ডিত বিহারে
ধর্মপালক ধর্মপাল / ঐতিহ্য থেকে ইতিহাস সার্থক এক নাম…তোমাকে প্রণাম।’
মৃত্যুর পূর্বে প্রণাম জানিয়েছিলেন সংঘনায়ককে। পরোপকারী শুদ্ধ সত্তার বিকাশ ঘটেছিল অমলেন্দু বড়ুয়ার মধ্যে। তাই তিনি-অমর-অক্ষয়। অমলেন্দু বড়ুয়ার ধ্বনি প্রতিধ্বনি আজো বাতাসে অনুরণন সৃষ্টি করে, আন্দোলিত করে। গোধুলীলগ্নে রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায়ী সূর্যের মতো কালে অমোঘ নিয়মে সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু তাঁর এই যাওয়া বড়ো অসময়ে। বেদনা বিদীর্ণ হৃদয়ে স্মৃতির বীণায় আজো বাজে তাঁর সেই সুমধুর স্মৃতিগুলো। অজান্তে নয়নের কোণে জমে ওঠে অশ্রুব্যথা ভরা মন যেন বলে উঠে…“তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা/কে বলে আজ তুমি নাই/তুমি আছো মন বলে তাই।”
তাঁর অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী গুণগ্রাহী তাঁর স্মৃতির কথা বলে, তাঁর অনন্য সৃষ্টির কথা বলে।
লেখক : অমলেন্দু বড়ুয়ার ভাতুষ্পুত্র এবং সাহিত্যিক সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়ার একমাত্র পুত্র