বিরোধে শেষ হতে চলেছে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাত। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের বিরোধ, দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করা, মেয়াদ শেষেও জোরপূর্বক চেয়ার দখল করে রাখা, চুক্তি ও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে শত শত জাহাজ বিভিন্ন ফ্যাক্টরিকে ভাড়া দিয়ে রাখাসহ নানা কারণে স্থবিরতার মুখে পড়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাত। লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) নানাভাবে চেষ্টা করেও স্থবিরতা থেকে বের হতে পারছে না। নৌবাণিজ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনাও উপেক্ষিত হচ্ছে পদে পদে। সবকিছু মিলে অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করেছে।
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বের নানা দেশ থেকে ভোগ্যপণ্য, কয়লা, পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করে। এসব পণ্যবাহী যেসব মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরে আসে সেগুলো জেটিতে বার্থিং নিতে পারে না। বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করে। ওখান থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে ফিরতি পথ ধরে। এভাবে বন্দরের বহির্নোঙরে বছরে অন্তত ১০ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং হয়। বেসরকারি মালিকানাধীন প্রায় ১৮শ লাইটারেজ জাহাজ দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে এসব পণ্য পরিবহন করে। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) তা নিয়ন্ত্রণ করছিল। লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাংয়ের (আইভোয়াক) সমন্বয়ে ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়। ডব্লিউটিসির প্রবর্তিত সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে আমদানিকারকরা জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহন করতেন। জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে লোকাল এজেন্ট এবং আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসিতে দায়িত্ব পালন করতেন। কোনো কোনো লোকাল এজেন্ট আবার পণ্যের এজেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বেশ কয়েক বছর এই প্রক্রিয়ায় আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনের জন্য পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসির নিকট প্রয়োজনীয় জাহাজের চাহিদাপত্র প্রদান করেন। ডব্লিউটিসি সিরিয়ালভুক্ত জাহাজ থেকে উক্ত পণ্যের এজেন্টের বিপরীতে বরাদ্দপত্র ইস্যু করে। লোকাল এজেন্ট জাহাজের যোগান দেন। পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসিকে জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করেন। ডব্লিউটিসি লোকাল এজেন্টের বরাবরে ভাড়ার টাকার চেক ইস্যু করে। জাহাজ মালিক লোকাল এজেন্ট থেকে ভাড়ার টাকা পেয়ে থাকেন।
প্রক্রিয়াটি শুরুতে গ্রহণযোগ্য থাকলেও পরে নানা অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় পড়ে। জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, জাহাজ বরাদ্দ না দেয়া, ডেমারেজ এবং ডেসপাসের টাকা নয়ছয়সহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে ডব্লিউটিসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জাহাজ মালিকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিপুল অংকের টাকা আটকে থাকাসহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মুখে গত বছর ভেঙে যায় ডব্লিউটিসি। জাহাজ মালিকদের একাংশ ডব্লিউটিসির কারণে দুর্নীতি এবং বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে মর্মে অভিযোগ তোলে নতুন করে আইভোয়াক নামে পৃথক প্ল্যাটফরম গঠন করে; যেখান থেকে আমদানিকারকদের জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এতেও সংকটের সুরাহা না হওয়ায় নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রামস্থ নৌ বাণিজ্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে একটি সেল গঠন করে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু আবারো পক্ষে–বিপক্ষে অবস্থানের কারণে সেই উদ্যোগও ভণ্ডুল হয়ে যায়। কোনো উদ্যোগ কার্যকর না হওয়া এবং জাহাজ মালিকদের সংগঠনের নেতাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মুখে দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটিতে বিশৃঙ্খলা লেগে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে দফায় দফায় বৈঠক এবং নানাভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। কয়েক দফা বৈঠক করে তৈরি করা হয় খসড়া বিধিমালা। পরে আরো যাচাই বাছাই করে ওই বিধিমালাকে ‘নৌপরিবহন অধিদপ্তর হইতে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহে পণ্য পরিবহন নীতিমালা–২০২৪’ শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
উক্ত নীতিমালায় বিডব্লিউটিসিসির আওতায় থেকে লাইটারেজ জাহাজসমূহ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহ ও তৎসংলগ্ন এলাকা হতে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, নির্বিঘ্ন ও সুশৃঙ্খলভাবে পণ্য পরিবহন করার স্বার্থে সরকার এই নীতিমালা প্রণয়ন করল। লাইটার জাহাজগুলোকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার মাধ্যমে লাইটার জাহাজ শিল্প এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের একটি সমন্বিত নীতিমালার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে লাইটার জাহাজ দ্বারা পণ্য পরিবহন সম্পর্কিত যে–কোনো বিষয়ে সকল অংশীজনের স্বার্থ রক্ষা করার স্বার্থেই নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, সুষম ও স্বচ্ছ ক্ষেত্র প্রস্তুতপূর্বক জবাবদিহিমূলকভাবে লাইটার জাহাজ পরিচালনার পাশাপাশি স্বল্পতম সময়ে লাইটার জাহাজ বরাদ্দের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলসীমায় আগত মাদার ভ্যাসেল হতে দ্রুত পণ্য খালাসের মাধ্যমে দেশের সমুদ্র বন্দরসমূহের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা এবং খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, সারসহ সকল আমদানি–রপ্তানি পণ্য যথাসময়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে সুষম সরবরাহে সহায়তা করতে দেশের সকল সমুদ্র বন্দর, সমুদ্র উপকূলীয় নদী বন্দর ও নদীর উভয় তীরে অবস্থিত সকল প্রকার জেটি, বহির্নোঙরে আগত মাদার ভ্যাসেল হতে পণ্য পরিবহন কাজে নিয়োজিত লাইটার জাহাজের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।
কিন্তু এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন হয়নি। লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অতীতের যে–কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। বিডব্লিউটিসিসিতে ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রামের একটি সংগঠন থাকলেও ঢাকার সংগঠনগুলোর সাথে চট্টগ্রামের সংগঠনটির কোনো যোগাযোগ নেই। বিডব্লিউটিসিসিতে কনভেনর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আবু সাঈদ ৩০ জুন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকার কথা। এ ব্যাপারে চুক্তিপত্রও হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তিনি এখনো কনভেনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিষয়টি নিয়ে ২৮ আগস্ট সভা হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর আবারো সভা করে নতুন কনভেনর নির্বাচনের কথা থাকলেও সেই সভা আর হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জাহাজ মালিকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অপরদিকে ২০১৯ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে জাহাজ মালিকদের ২১১ কোটি টাকা এবং গত নভেম্বর থেকে অন্তত ১শ কোটি টাকা ডেমারেজ বাবদ আটকা পড়ে রয়েছে। এসব টাকা আদায়ের জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি কাজ করে রিপোর্ট দাখিল করে। সেই রিপোর্টও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সব লাইটারেজ জাহাজ বিডব্লিউটিসিসির মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ জাহাজ মালিক সেটা মানছেন না। বিভিন্ন কারখানার নিজস্ব পণ্য আমদানিতে নিজস্ব জাহাজ ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ঢাকার মালিকদের শত শত জাহাজ বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে অবৈধভাবে ভাড়ায় দেয়া হয়েছে। এসব জাহাজকে সিরিয়ালভুক্ত করে চালানোর সব উদ্যোগ ভণ্ডুল হয়ে গেছে। শ্রমিকদের মাঝেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। চুরি করে মাসে দুই থেকে আড়াই ট্রিপ মারছে এমন জাহাজগুলোর শ্রমিকেরা ভালো থাকলেও পুরো মাসে এক ট্রিপ পায় এমন জাহাজের মালিকেরা শ্রমিকদের বেতন–ভাতা দিতে পারছেন না। এতে করে বৈষম্য বিরাজ করছে, যা শ্রমিকদের অস্থির করে তুলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জাহাজ ভাড়া নিয়ে ‘ভাসমান গুদাম’ বানিয়ে রাখার একটি অপচেষ্টাও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গম নিয়ে আসা জাহাজগুলোকে গুদাম বানানো হচ্ছে। গমের জাহাজ বাড়ার সাথে সাথে বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
বিডব্লিউটিসিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, লাইটারেজ সেক্টরে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এ সেক্টরকে ঠিক রাখা না গেলে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটের চেইন ভেঙে পড়বে।