আজ ছাব্বিশে মার্চ। বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন। মহান স্বাধীনতা দিবস। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী। এই দিনটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক দুঃখ-কষ্ট-বেদনা, রয়েছে অনেক উচ্ছ্বাস, আবেগ, অনুভূতি আর আনন্দবেদনার মিশ্রণ। অনেক ত্যাগ, অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্তের বিনিময়ে এসেছে এ স্বাধীনতা। সেজন্য এদেশের বীর যোদ্ধা যারা দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সেসব বীর সূর্য সৈনিকদের জানাই অজস্র সালাম আর শ্রদ্ধা। আমরা শ্রদ্ধা জানাই স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সব সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাকে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দৃপ্ত শপথের দিন আজ।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০টি বছর পার হয়েছে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ-স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বিশ্লেষকদের মতে, রূপকল্প ২০২১-এর এ বছরটি একটু ব্যতিক্রমী এ কারণে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। ২০২১-এর বাংলাদেশ আজ অন্য রকম এক বাংলাদেশ। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ব নেতাদের কারো কারো মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’, কারো মতে, ‘উন্নয়নের রোল মডেল, কারো মতে, অফুরন্ত সম্ভাবনার এক বাংলাদেশ। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে আমরা অন্যরকম এক বাংলাদেশকে দেখছি।
বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির ফলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও বাংলাদেশ অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করছেন। করোনা মোকাবিলা সক্ষমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বিশ্বে ২০তম। এ অভূতপূর্ব অগ্রগতি আমাদের ধরে রাখতে হবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকগুলো আমাদের তা মনে করিয়ে দিচ্ছে। উন্নয়নের এ ধারা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে অভাবিত উন্নয়ন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের ফলে।
মহাকবি মিল্টন বলেছিলেন,‘স্বাধীনতা মানুষের প্রথম এবং মহান একটি অধিকার’। কিন্তু স্বাধীনতাকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করতে হলে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজের আবশ্যকতা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। থিওডোর পার্কারের ভাষায়, ‘চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে এবং উপাসনার স্বাধীনতা থাকবে- এই হলো গণতন্ত্রের আদর্শ।’ সেই আলোকে আমরা পর্যালোচনা করবো আমাদের অর্জনকে, আমাদের প্রাপ্তিকে।
স্বাধীনতার চেতনার একটি ছিল বৈষম্যের অবসান। তদানীন্তন শাসকচক্র আমাদের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করেছে শুরু থেকেই। তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার ফলে আমরা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে একটা গণ-অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। এতে মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা, বৈষম্যের অবসান ও সামাজিক অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তির জন্য আমাদের পৃথক রাষ্ট্রকাঠামো প্রয়োজন; যার শাসন ও পরিচালন ভার নিতে হবে নিজেদেরই। ফলে এক অনিবার্য বাস্তবতায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই পাকিস্তান ভূখণ্ডের পূর্ব অংশ আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হওয়া বড় অর্জন বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে ৩টি শর্ত রয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৩টি শর্তই পূরণ করে। পরে ২০২১ সালেও ৩টি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০৩৫ সালের মধ্যে আমাদের এ দেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। এই অগ্রযাত্রা ও উন্নয়ন আমাদের আশান্বিত করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।