Your children are not your children
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself
They come through you but not from you
And though they are with you yet they belong not to you.
( Kahlil Gibran)
চট্টগ্রামের শঙ্খ নদীর পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে বরমা ইউনিয়ন। এই গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক ফোরক আহমদ চৌধুরী ও মনসুরা খাতুনের সন্তান – যিনি ১৯৬৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে লঞ্চে চড়ে চট্টগ্রাম শহরে পা রেখেছিলেন। সাথে ছোট ভাই। বয়স তখন কত? মাত্র এগারো। শঙ্খ নদীর আবহে জন্ম হওয়া সেই এগারো বছরের ছেলেটির কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বন্দর নগরী চট্টগ্রামে শুরু হলো আরেক উপাখ্যান।
শঙ্খ পারের সেই ছেলেটি কালক্রমে নিজের কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও মননশীলতায় হয়ে উঠলেন অভীক ওসমান। তাঁর এই বর্ণাঢ্য জীবন তো আর কেউ গড়ে দেয়নি। নিজের মত করে গুছিয়েছেন, সাজিয়েছেন, স্রোতের তোড়ে ভেসে না গিয়ে উঠে এসেছেন সমাজের উঁচু জায়গায়।এজন্যই বিনীতভাবে স্মরণ করলাম আরবী সাহিত্যিক কাহলিল জিবরানের কবিতাটিকে।
সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমি অকৃতী অধম’ শীর্ষক আত্মজীবনীগ্রন্থ। বইটির লেখক অভীক ওসমান। যিনি তাঁর জীবনকে উপস্থাপন করেছেন সময়ের বিভিন্ন কালকে। যেখানে চিত্রিত হয়েছে জীবনের বর্ণিল অধ্যায়।
বিশাল বিটপী অহংকারে গেড়েছ মূল, শিকড়ের বিস্তীর্ণ আস্তানা
পাশে শুদ্ধজলের জলাধার, জল সেচে সজীব হৃদয়
(বিরাট বিটপীর অহংকার : অভীক ওসমান)
এমন কবিতা তিনিই লিখেছেন। বিটপী‘র সন্ধান করতে গিয়ে নানান বর্ণিল কর্মকাণ্ডে কখন যে তিনি নিজেই বিটপী হয়ে আছেন, তা উপলব্ধি করি – ‘আমি অকৃতী অধম’ বইটি পাঠ করে। এতে রয়েছে ৫৬টি অধ্যায়। এবং সবশেষে ‘পাঠকের জন্য খোলা চিঠি’। রাজনৈতিক কর্মী, প্রেস কর্মী, কবি, নাট্যজন, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যাণ্ড ইন্ডাস্ট্রির পদস্থ কর্মকর্তা এবং পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দায়িত্বশীল পদে কাজ করার মত বহুভাবে প্রতিনিধিত্বশীল কাজ করে যাওয়া একজন অভীক ওসমান জীবনের ৭০টি বসন্ত পার করে আসা। সুতরাং, তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমি অকৃতী অধম’ বিশাল একটি কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে মেলে ধরেছে পাঠক সমাজে।
শেকড় ভুলে যাননি অভীক ওসমান। আমার জন্ম এবং শৈশব, গোষ্ঠী বৃত্তান্ত, পিতৃস্মৃতি: একজন মানুষের মত মানুষ, মাকে মনে পড়ে, সেকেন্ড মাদার মা‘হাক্কা, মাতৃতুল্য বুবু, অন্যান্য ভ্রাতা ও ভগ্নীগণ, পটিয়া নানাবাড়ি, শেবন্দীর নানাবাড়ি মামাবাড়ি, পাগল বানাইল পাগল, শৈশবের হাটবাজার, সাধু শুক্লাম্বরের মেলা, আমার রাখাল বন্ধুরা – এই শিরোনামে লেখাগুলো পড়ে অন্য অনুভূতির জন্ম নেয়। মনে হয়, এখনো তিনি সেই কিশোরেই আছেন। তার অপেক্ষায় আছে শঙ্খ, সবুজ মাঠ, শৈশবকাল, সোনালু ফুল আর বুড়ো বট গাছ।
৪০ নং মোমিন রোড – শীর্ষক লেখায় একজন কিশোরের বেড়ে ওঠার অধ্যায় শুরুর কথা জানতে পারি। পড়ালেখার ফাঁকে সংগঠন করা, সাহিত্য চর্চা, রাজনীতির পাঠ শুরু – এখান থেকেই। তারপর এগিয়েছে কাজেম আলী হাই স্কুল, নিউ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ঢাকা অধ্যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্বগুলো। নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রামে, বলা যায় শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মনোনিবেশকারী হিসেবে ব্যস্ত এই সময়কাল। যার প্রভাব আমরা পেয়েছি কালক্রমে।
অভীক ওসমান একজন রাজনৈতিক কর্মী কিশোর বয়স থেকেই, তার বর্ণনা তিনি লিখেছেন ‘পলিটিক্স বিফোর লিবারেশন ওয়ার’ শীর্ষক লেখায়। তিনি লিখেছেন: ‘যে পরিচয়টি অভীক ওসমান বললেই আগে আসে সেটা হলো রাজনীতিবিদ। অনেক ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিতে প্রবেশ আমার। যে বয়সে খেলাধুলার সময়, ছুটে বেড়ানোর সময়, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় সেই সময়টি আমি রাজনীতিতে দিয়েছি, দেশকে দিয়েছি। এই প্রেক্ষাপট আমাদের তখনকার সময়ই আমাদের তৈরি করেছে।’ তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি একজন অনতিতরুণ একাত্তর পূর্ব গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এটাও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের যে কমিটমেন্ট সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার কথা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী‘ নামে এক যৌবন জলতরঙ্গ ঢেউ তুলেছিল, জেল–জুলুম, হাতে পায়ে গ্রেনেডের ক্ষত নিয়ে এই মুভমেন্টে সামিল হয়েছিলেন, তিনি অভীক ওসমান।
কিন্তু শুধু যে রাজনীতির বলয়ে আবদ্ধ ছিলেন তিনি, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে এগিয়েছেন সাহিত্য – সংস্কৃতি ও নাট্য আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে। তাঁর একটি বড়ো গুণ – তিনি একজন শুদ্ধ পাঠক। যা এখনো বজায় রেখে চলেছেন। সেসাথে লেখালেখিও। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে দেয়ালিকা সম্পাদনা, বিতর্কে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও অংশগ্রহণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নিজেকে গড়ে তোলার মজবুত ভিত তৈরি করে নেন। ‘তিন দশকের সাহিত্য আন্দোলন’ শিরোনামে এই প্রবন্ধে সেই বর্ণাঢ্য কর্ম প্রকাশ আমরা পাই।
অভীক ওসমান প্রায় সময় বলে থাকেন, তাকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। আসলেই কিন্তু তাই। একটু ভেবে দেখুন, ষাটের দশকে শঙ্খ নদীর পারের সেই কিশোরটির যাত্রা পথে কত ঝড়, ঝুঁকি এসেছে। ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। দমে যাননি। একে একে মেলে ধরেছেন স্বমহিমায়। নাট্যকার, নাট্যকর্মী অভীক ওসমানকেও আমরা পেয়ে যাই – এ যেন আরেক ফিনিক্স পাখি।
‘নাটক হচ্ছে শিল্পের সোভিয়েত : গণায়ন নাট্য সমপ্রদায়ের কথা ( ১৯৭৫–২০২৪)’ – এই প্রবন্ধে লিখেছেন তিনি তাঁর নাট্য আন্দোলনের চেতনার কথা। নাট্যকার হওয়ার কথা। একই সাথে চিত্রিত করেছেন গণায়ন নাট্য সমপ্রদায়ের সুদীর্ঘ সময়ের চলমান নাট্য আন্দোলনের কথা।
অভীক ওসমানের কর্মজীবনও নাটকীয়তায় পূর্ণ। শুরু হয়েছিল পটিয়া এ. জে. চৌধুরী কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় কিছুকাল শিক্ষকতা করে পরবর্তীতে বরমা কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হলেন।
এরপর তিনি যোগ দিলেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের আগ্রাবাদস্থ সচিবালয়ে ইকোনমিক রিসার্চ অফিসার হিসেবে, ১৯৮৫ সালের ২ মে। এরপর উপসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে সুদীর্ঘ তিরিশ বছর একটানা কাজ করে গেছেন চট্টগ্রাম চেম্বারে অব কমার্সে। এই গ্রন্থে তিনি ” চেম্বার অধ্যায়” শীর্ষক লেখায় বিশদ আলোচনা করেছেন। চট্টগ্রাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার পরিকল্পনা ও বাস্তবয়ান কাজে কীভাবে তিনি যুক্ত থেকেছেন, তার বর্ণনা আছে। এবং সাথে আর যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কথাও স্মরণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন: “আমার প্রীত হওয়ার বিষয় যে, নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্মেসড হওয়ার আগেই আমি মার্কিন মুলুকে দেখেছি, এবং সেটার আদলে গড়ে তুলবার জন্য চেষ্টা করেছি।“
এবার আসা যাক: লেখক অভীক ওসমান প্রসঙ্গে। ” আমার লেখালেখি ” শীর্ষক লেখায় বিশদ বর্ণনা আছে। তিনি বলছেন: “আমার জীবন ও কর্মের প্রতিফলন, আমার জীবনের সংগ্রাম, আমার বিশ্বাস, এবং আমার ইমোশনকে রিফ্লেক্ট করেছি আমার নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ এবং নিখিল লেখালিখিতে।” অভীক ওসমানের প্রকাশিত কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থের তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, শঙ্খ পারের সেই কিশোরটি কী অদম্য মনোবলে ও নিভৃতে লেখালিখি করে চলেছেন।
অভীক ওসমান বিটপী। কেন? তার উত্তর মিলবে ‘আমি অকৃতী অধম’ বইটি পাঠে। ‘পাঠকের জন্য খোলা চিঠি’– তে তিনি বিনয়ের সাথে লিখেছেন: ” আমার এই দীর্ঘ অধ্যায়ে আপনাদের ভালোবাসা, প্রীতি, আন্তরিকতা, মায়ামমতার বন্ধনে সিক্ত। আমি বিশেষ কোনো সেলিব্রিটি নই।… সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছি, আন্দোলন করেছি। আমি বিশ্বাস করি এই সাম্য প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।’
আশাকরি অভীক ওসমানের সুলিখিত আত্মজীবনী ‘আমি অকৃতী অধম’ সকল পাঠকের সুখপাঠ্য হবে। মানুষকে জানার সুযোগ তৈরি হয় এই ধরনের আত্মজীবনী গ্রন্থ পড়ে। এমন অস্থির এক সময়ে এই বইটি প্রেরণামূলক বই হিসেবে নবপ্রজন্মের পাঠকের কাছে পৌঁছাবে আশাকরি।
‘আমি অকৃতী অধম’, প্রকাশক : ঐতিহ্য, ঢাকা, প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০২৫, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, মূল্য : আটশত টাকা
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী