অভিনন্দন জাতির গর্ব প্রফেসর ইউনূস: পূরণ হোক গণমানুষের স্বপ্ন

মুহাম্মদ মুসা খান | শুক্রবার , ৯ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেনএই সংবাদটি আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত আনন্দময়। ‘চট্টলগৌরব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নির্বাচিত হওয়াতে চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে আমরা এই প্রিয় নেতাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, . মুহাম্মদ ইউনুস এই মুহূর্তে দেশে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারবেন। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এখন বেশ অস্থিতিশীল। এ পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রফেসর ইউনূস ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে এটি একটি বৈধ এবং স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এই ব্যাংক বিনাবন্ধকীতে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত বিশেষায়িত সামাজিক উন্নয়ন ব্যাংক।

আমরা সকলে অবগত আছি যে, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। গরীব দেশের মানুষের জন্য ‘করোনা টিকা’ আন্দোলনের কারণেই এশিয়াআফ্রিকার অনেক গরীব দেশের ‘করোনা টিকা’ প্রাপ্তি সহজ হয়েছিল। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময় নোবেল কমিটি বলেছিলেন, ‘দারিদ্রতা শান্তির জন্য অন্তরায়। প্রফেসর ইউনুস দারিদ্র বিমোচনের কাজ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী অবদান রেখেছেন।’ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সৃজনশীল কাজের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইতোমধ্যে কয়েকশো পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। যা বর্তমান পৃথিবীতে একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। তাঁর পাওয়া পুরস্কার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো (আন্তর্জাতিক)- ১৯৮৪ সালে ফিলিপাইনের র‌্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (১৯৯৪), সিডনি শান্তি পুরষ্কার (১৯৯৮), প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৮), নোবেল শান্তি পুরষ্কার (২০০৬), সিওল শান্তি পুরস্কার (২০০৬), যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ও কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (২০১০), ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার ইত্যাদি। ক্রীড়া জগতের ‘সর্বোচ্চ পুরস্কার’ অলিম্পিক লরেল‘ (২০২১)ফোর্বস ম্যাগাজিনের‘ ‘টেন মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল বিজনেস গুরুস’ তালিকায় মুহাম্মদ ইউনূসও ছিলেন। ২০১৩ সনের ৫ জুন প্রফেসর ইউনূসকে সম্মাননা দিয়েছিলো আমেরিকার প্রভাবশালী ফোর্বস ম্যাগাজিন’’।বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্পদশালী ব্যাক্তিবর্গের এই সম্মেলনেবাংলাদেশের প্রফেসর ইউনূসও বিশ্বের সব বিনিয়োগকারীর শিক্ষাগুরু– ‘ওয়ারেন বাফেটকে সম্মাননা প্রদান করেছিল। পৃথিবীর ২০জন সম্মানিত ব্যক্তির তালিকায় তিনি নবম স্থানে ছিলেন।

দুঃখজনক সত্য হলো, বিশ্বব্যাপি এত সম্মান, পুরস্কার ও গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অহংকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার কারণে তিনি অবহেলিত ছিলেন। বায়বীয় সব অভিযোগে সময়েঅসময়ে, কারণেঅকারণে তাঁকে নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে সরকার ও তাঁর সাংগপাংরা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কেড়ে নিয়েছিলেন। ব্যাংক ভবন হতে তাঁর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস হতে প্রফেসর ইউনূসের নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছিল! অত্যন্ত নিন্দনীয় যে, শেখ হাসিনা তাঁকে ‘পদ্মানদীতে চুবানোর’ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার কারণে মিথ্যা মামলায় তাঁর জেলে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, শেখ হাসিনা তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও বাংলাদেশেও হাসিনা সরকারের আগে তিনি সরকারি ও বেসরকারি প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন। পুরস্কারগুলো হলোবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (১৯৭৮), সেন্ট্রাল ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৫), স্বাধীনতা পুরষ্কার (১৯৮৭), রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এ খান মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪) ও ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪), আরসিএমডি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৫)। স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রফেসর ইউনূসই আমেরিকায় অনুষ্ঠিত প্রথম মাইক্রো ক্রেডিট সামিটে১৯৯৭ সনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে কখনোই সামান্যতমও কোন নেতিবাচক কাজের অভিযোগ পাওয়া যায়নি (যেমনদুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রীয় তহবিল আত্মসাৎ, ভূমিদস্যুতা, কালো টাকা সাদা করা, অর্থ পাচার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ইত্যাদির কোন অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে কখনোই ছিল না)। হাঁ, মামলামোকাদ্দমা যা হয়েছে, সেসব শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার কারণে, যা ওপেন সিক্রেট। অথচ বাংলাদেশ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, টাকা পাচার,ও কালো টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ ছিল। শেয়ার বাজার ধ্বংস করেছিল সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। কিন্তু হাসিনা সরকারের টার্গেট ছিল নিরপরাধ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি সর্বশেষ বিশ্বব্যাপি ‘সোস্যাল বিজনেস থিওরি’ ও থ্রি জিরো তত্ত্ব (শূন্য কার্বন নির্গমন, সম্পদের শূন্য পুঞ্জিভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব) বাস্তবায়নে কাজ করছেন। আর, বিশ্বব্যাপি দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করছেন। অথচ দুঃখজনক হলো, এই মানুষটা শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। কথায় বলে,‘’কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো গেলেও, সব মানুষকে সবসময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না।” বাংলাদেশের মানুষকেও বোকা বানানো যায়নি। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড রকম বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ অবশেষে উনার প্রতিভার মূল্যায়ন দেখতে পেলেন। কিংবদন্তিতুল্য এই ব্যক্তিত্বের হাতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব তুলে দিয়ে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ সমন্বয়ক ও বুদ্ধিজীবীরা অত্যন্ত দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। সরকারের সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, যেনো বিগত সরকারের যাবতীয় ‘অনিয়ম’ চিহ্নিত করে সেসব দূর করে দেশে সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমরা আশা করবো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করবেন। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবেন। সরকারি অফিসআদালত হতে দুর্নীতি দূর করার উদ্যোগ নেবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আগের সরকার আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ধ্বংস করে ফেলেছে। পূর্ববর্তী শিক্ষা কারিকুলামের সাথে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সংমিশ্রণে নতুন করে শিক্ষাকারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা একটু বেশি। নামে বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও চট্টগ্রাম বরাবরই অবহেলিত ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতিতে সিংহভাগ টাকার যোগান দিলেও চট্টগ্রামের সমস্যা সমূহ সমাধানের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখনো সামান্য বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহর তলিয়ে যায়। কালুরঘাট ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া। চট্টগ্রামে ভাল কোন পার্ক নাই। একটি সুন্দর পার্ক প্রতিষ্ঠা করা। আমরা আশা করবো, চট্টগ্রামের সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে চট্টগ্রামকে একটি আধুনিক সুন্দর শহরে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেএকটি ‘অসামপ্রদায়িকসমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ তৈরির জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে কোন সামপ্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, ধর্মকে রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ধর্ম ও দেশের জন্য ক্ষতিকর, যা আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। প্রতিহিংসার রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, রাজনীতি ও ধর্মের নামে প্রতিটি দেশেই হিংস্র হানাহানি হয়। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের দিন আমাদের এখানেও প্রচুর লুটপাট হয়েছে। যা অবশ্যই নিন্দনীয়। এসব লুটপাট ও সংখ্যালঘুদের উপর হামলার তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। আমরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় হানাহানিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখি। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে বাংলাদেশ একটি সুখীসমৃদ্ধশালী ও মর্যাদাবান দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে এবং সমগ্র পৃথিবীতে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকারের হাত ধরে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুমিনের গুণাবলী
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা