অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষা বিষয়ক একটি ক্ষুদ্র প্রস্তাবনা

কর্নেল আবু নাসের মোঃ তোহা ।। বিএসপি, এসজিপি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি (অব.)

| মঙ্গলবার , ১ অক্টোবর, ২০২৪ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসর গ্রহণ করার পর ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারী নিজস্ব “লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” অনুসরণ করে লিডার্স স্কুল এন্ড কলেজ চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করি। আমরা সরকারি পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করি এবং সরকারি সকল নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করি। কিন্তু আমাদের নিজস্ব শিক্ষাক্রম “লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” অনুসরণ করে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। এই শিক্ষা মডেল এর লক্ষ্য হলো “ভালো মানুষ গড়ে তোলা”। ভালো মানুষ বলতে আমরা বুঝি, “যে মানুষ কখনো কারো ক্ষতি করে না ও সকলের প্রতি সহমর্মিতার মানসিকতা পোষণ করে এবং তার উপর অর্পিত যে কোনো পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে”। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৩ টি উদ্দেশ্য/কার্যক্রম হলো১। শ্রেণি উপযোগী যথাযথ জ্ঞান নিশ্চিত করা। ২। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা। ৩। প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী সকল বিষয়ে পারদর্শী করে গড়ে তোলা। অর্থাৎ “লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর লক্ষ্য অর্জনের ৩ টি উপাদান হলোজ্ঞান, নৈতিকতা ও দক্ষতা।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা ভিত্তিক হওয়ায় সকলে পরীক্ষার্থীতে পরিনত হয়েছে, কোথাও কোনো শিক্ষার্থী নেই। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য অত্র প্রতিষ্ঠানে “লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে “লিডার্স পাঠ পদ্ধতি”, যা হলো– “শিক্ষার্থীরা প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে, প্রতিটি বাক্য সঠিকভাবে উচ্চারণ করে, উচ্চ স্বরে পড়বে এবং প্রয়োজনে লিখে অনুশীলন করবে”কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি অধ্যায় শেষ করার পর ৪ টি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তা হলোবাড়ির কাজ, শ্রেণি অভীক্ষা, প্রকল্প কার্যক্রম, এবং সারমর্ম ও প্রয়োগ। বাড়ির কাজের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট অধ্যায় পাঠ শেষে “লিডার্স পাঠ পদ্ধতি” অনুসরণ করে কিছু প্রশ্ন বের করতে হয় এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখে জমা দিতে হয়, যা শিক্ষক সংশোধন করে শিক্ষার্থীকে ফেরত প্রদান করে। প্রকল্প কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থী অধ্যায়টি বারবার পাঠ করতে বাধ্য হয় এবং সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটাতে পারে। সারমর্ম ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ৫ হতে ১৫ বাক্যের মধ্যে অধ্যায়টির সারমর্ম /সারাংশ লিখে এবং কমপক্ষে ৩ টি প্রয়োগ লিখে, যা হলোসরাসরি প্রয়োগ, সামাজিক প্রয়োগ ও নৈতিক প্রয়োগ। প্রতিটি অধ্যায় পাঠ শেষে অধ্যায়ের উপর শ্রেণি অভীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এই ৪ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিটি অধ্যায় পাঠ করে শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে এবং শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পূর্ণ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়, বিধায় কোনো ষান্মাষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার আয়োজন করার প্রয়োজন হয় না। ফলে প্রায় ২/৩ মাস পাঠ ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন নিশ্চিত করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে অত্র প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা অর্জন নিশ্চিত করণের ভিত্তি হলো ৩ টি বিশ্বাস, যা হলো১। সৃষ্টিকর্তা অন্তর্যামী। তিনি সব দেখেন, সব শুনেন ও সব জানেন । ২। সৃষ্টিকর্তা সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। তিনি মানুষের সকল কর্মের বিচার এই জীবনে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের করবেন। ৩। মানুষের জীবনের সকল ঘটনা বা ভাগ্য সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত এবং তিনি তা নির্ধারণ ও পরিবর্তন করেন মানুষের কর্মের উপর ভিত্তি করে। “লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে নৈতিকতা অর্জনের উপায় হলোশিক্ষার্থীদের হৃদয়ে, মস্তিকে ও আচরণে এই ৩ টি বিশ্বাস গ্রথিত করা এবং মূল্যবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, আনুগত্য, সহযোগিতার মনোভাব ও শিষ্টাচার।

৫ টি বিষয় জাগ্রত করা। অত্র প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে উপরোক্ত বিশ্বাসগুলো এবং ৫টি উপাদান ও সংশ্লিষ্ট উপউপাদানগুলি অর্জন ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে দক্ষতা অর্জনের উপায় হলোশিক্ষার্থীদের প্রকাশ ক্ষমতা, বিশ্লেষণ দক্ষতা, সহনশীলতা, জানার আগ্রহ, নেতৃত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে পরিপূর্ণ অনুধাবন নিশ্চিত করা, কার্যকরী অনুশীলন করানো এবং বয়সোপোযাগী পারদর্শী করে তোলা।

অত্র প্রতিষ্ঠানে পাবলিক স্পিকিং, ক্রিয়েটিভ রাইটিং, বুক রিভিউ, মানচিত্র পঠন, নেতৃত্বের দায়িত্ব, আন্তঃহাউজ প্রতিযোগিতা, সাপ্তাহিক ক্লাব কার্যক্রম, বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, রেড ক্রিসেন্ট, গার্লস গাইড, স্কাউট ইত্যাদিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে উপরোক্ত ৬ টি উপাদান ও সংশ্লিষ্ট উপউপাদানগুলি অর্জন ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে প্রতি বছর সকল শিক্ষার্থীকে ২ বার মূল্যায়ন করা হয়। এই মূল্যায়নে জ্ঞানের ৪ টি কার্যক্রমে ৪০ নম্বর, নৈতিকতার ৫ টি বিষয়ে ৩০ নম্বর এবং দক্ষতার ৬ টি বিষয়ে ৩০ নম্বর প্রদান করে ১০০ নম্বরে মূল্যায়ন করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য সৎ, দক্ষ, আন্তরিক ও নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক এবং পরিমিত সংখ্যক শিক্ষক অত্যন্ত জরুরি বিধায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততা নিশ্চিত করা হয় এবং তার পরীক্ষার ফলাফলের চাইতে জ্ঞান, নৈতিকতা ও দক্ষতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে অত্র প্রতিষ্ঠানে মোট ৬৪ জন শিক্ষকশিক্ষিকা এবং মোট ৩৬ জন কর্মকর্তাকর্মচারী আছে। নিয়মিত পেশাদারিত্ব উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদের সপ্তাহে ২ দিন বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সুনির্দিষ্ট লিখিত চাকরি বিধিমালার মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়মিত পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, বিভিন্ন ভাতা, ভবিষ্যত ও কল্যাণ তহবিল এবং সামাজিক ও পারিবারিক সহযোগিতা ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকদের চাকরি নিরাপদ, আনন্দদায়ক এবং সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভালো মানুষ ও দায়িত্ববান অভিভাবক অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যে নিয়মিত আনুষ্ঠানিক অভিভাবক সমাবেশ, শ্রেণি ভিত্তিক মাসিক অভিভাবক সমাবেশ, বিশেষ অভিভাবক সমাবেশ এবং যে কোনো প্রয়োজনে অভিভাবকদের সাথে সাক্ষাৎকার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও নিয়মিত অভিভাবক প্রশিক্ষণ এবং অভিভাবক সম্পর্কিত সেমিনার আয়োজন করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্র প্রতিষ্ঠানে সুপ্রশস্ত তথ্যবহুল শ্রেণিকক্ষ, সকল সুবিধা সম্বলিত বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরি, ইনডোর গেমসের জন্য কমনরুম, মিলনায়তন, খেলার মাঠ, পরিবহন সুবিধা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, অভিভাবক কক্ষ ও পরিকল্পিত ফুলের বাগান সম্বলিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শিক্ষাসহায়ক আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত অবকাঠামো নিশ্চিত করা হয়।

প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করে পরিচালিত হয় এবং সকল ক্ষেত্রে প্রত্যেকে নিজের নিজের কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পরিচালনা করে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত স্থায়ী নির্দেশাবলী/গঠনতন্ত্র আছে এবং প্রতিষ্ঠানের সকলে তা কঠোরভাবে অনুসরণ করে।

অত্র প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের পার্শ্বস্থ একটি এতিম খানার শিক্ষার্থীগণ বিনামূল্যে পড়াশোনা করে। এছাড়াও যে কোনো সময় যে কোনো শিক্ষার্থী অসচ্ছলতায় পতিত হলে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের “শিক্ষা সহায়ক তহবিল” থেকে প্রয়োজনীয় বৃত্তি প্রদান করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, করোনা চলাকালীন অবস্থায় ২০২০ ও ২০২১ সালে শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফী’র বিশাল অঙ্কের টাকা মওকুফ করা হয়।

লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে অত্র প্রতিষ্ঠানে প্লে থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা প্রতিবছর আমাদের কার্যক্রম বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছি এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করছি। আমাদের স্বপ্ন “লিডার্স শিক্ষা মডেল২০১৮” এর আলোকে কিছু ভালো মানুষ গড়ে তোলা।

লেখক: অধ্যক্ষ, লিডার্স স্কুল এন্ড কলেজ চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে আজাদী পরিবারের কয়েকজন গুণী সাংবাদিক