পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষটিও গোটা দিনের মধ্যে দুর্দণ্ড সময় বের করে তার প্রিয়জনদের খোঁজ নিতে পারে না–এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। যতদূরে থাকা হোক, যত ব্যস্ততায় কাটানো হোক যদি ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকে তবে অপেক্ষা করা মানুষগুলোর সাথে একটুখানি যোগাযোগ করা যায়। প্রিয় মানুষদের খোঁজ না করা, কথা না বলা একসময় আফসোসের কারণ হয়। যখন দূরত্ব বাড়তে বাড়তে দুনিয়ায় কোনো মাপকাঠি দিয়ে ব্যবধান পরিমাপের সুযোগ থাকবে না তখন আর প্রায়শ্চিত্তের অপশনও থাকবে না।
ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে আমরা অনেকেই নিয়মিত বাবা–মায়ের খোঁজ রাখি না। গোটা দিনের মধ্যে কয়েক মিনিট কথা বলতে কার্পণ্য করি। খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে ভাবি সন্তান হিসেবে বোধহয় দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি! অথচ বাবা–মা আশা করেন, অপেক্ষা করে থাকেন তাদের সন্তানের কণ্ঠ শুনতে, একটু দেখতে। এই–যে এড়িয়ে যাওয়া, দূরে থাকলেও রোজ অন্তত একটু সময় কথা না বলা, পাশাপাশি থেকেও তাদের কাছে একটু সময় না বসা–এসবই একদিন সন্তানদের গুরুতর ভোগায়।
পিতামাতার অসহায়ত্বের সময়, উদাস চাহনির অর্থ যৌবনের উড়ন্ত বেলায় সন্তানের উপলব্ধিতে না এলেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় সবাই ঠিকঠাক মতোন টের পায়। অবহেলা দ্বিগুণ হয়ে ফেরত আসে। আজীবন মাতাপিতার কণ্ঠ শোনার সৌভাগ্য হয় না কারো। তাদের পাশে বসে তাদের ভরসা দেয়ার, দু’চোখ ভরে দেখার সুযোগ মিলবে না হয়তো। সেই দিনগুলোতে যাতে আফসাসে পড়তে না হয় সে–জন্য হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও বাবা–মায়ের জন্য কিছুটা সময় আলাদা হোক।
যে স্ত্রী/স্বামী অপেক্ষা করে থাকে, প্রিয় মানুষের সাথে একটু কথা বলতে যার মন ছটফট করে তাকে সময় দিন। সুযোগ বের করে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ুন। শারীরিক সুস্থতার কালে স্মৃতি জমা করুন। এই–যে উড়ে চলা, ব্যস্ততায় ডুবে যাওয়া এসব কার জন্য? সেই মানুষটি যদি প্রয়োজনের সময় আপনাকে না পায়, ভাগাভাগি করতে না পারে মনের কথা তবে সেই মানুষটি যে মনোকষ্টের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করে সে–সবের যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারেন? মানুষ যতটা ব্যস্ততা দেখায় সে আসলে ততটা ব্যস্ত নয়! দিনের মাঝে কয়েকবার সময় বের করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য খোঁজ নিলে তাতে কাজের বারোটা বাজে না বরং গতি বাড়ে। সাফল্য–প্রাপ্তির হার বাড়ে! দূরে থাকা মানুষটির মনে আপনার ছাপ ভালোভাবে পড়ে। কাছের মানুষটিও মনে মনে আপনাকে ভাবে।
স্বামী/স্ত্রী’র যদি রোজরোজ খোঁজাখুঁজি না হয় তবে বোঝাবুঝির দূরত্ব বেড়ে যাবে। স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক কাঠ–পেরেকের সম্পর্ক নয় যাতে সেটা রসকষহীন থাকবে! এখানে ন্যাকামি থাকবে, বোকামি থাকবে, অভিমানও থাকবে। খেয়েছে কি–না, পৌঁছিয়েছে কি–না, কী করছে–এসবের খোঁজ রাখাও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। যদি মনের মিল না হয় তবে অন্য কোনো কেমিস্ট্রি জমে না। ব্যস্ততা দেখিয়ে বাইরে বাহবা পাওয়া, সুনাম কুড়ানো কিংবা অর্থ কামাইয়ে চেষ্টা অর্থহীন, যদি ঘরের শান্তি না থাকে! নিয়ম করে কথা বলা, মান–অভিমানের ভাষা বুঝে যত্ন নেওয়া এবং চাওয়া–পাওয়া বুঝতে পারার মধ্যেই জাগতিক কল্যাণ ও মানসিক প্রশান্তি নিহিত থাকে!
সন্তানকে সময় না দিয়ে, তার খোঁজখবর না রেখে ক্ষমতা–সম্পদের পিছনে এতোটা ছোটা উচিত না, যাতে আপনি অসুস্থ হলে সন্তান ডাক্তারের কাছে ফোন দেওয়ার আগে উকিলের কাছে ফোন দেওয়া জরুরি মনে করে! সন্তানের বয়স ভুলে গিয়ে কেবল সাইজ কতটুকু সেটা দেখানোর নির্বুদ্ধিতায় ডুববেন না! সে কোন ক্লাসে পড়ে, জন্মদিন কবে, কীভাবে হাসে–সেসব মনে রাখবেন। সন্তান ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে ঘরে ফিরুন! সন্তান জাগার পরে ঘর থেকে বের হোন! সন্তানের সাথে আপনার কিছু স্মৃতি থাকুক। যেখানে থাকুন, যত ব্যস্ততায় থাকুন সময় বের করে নিয়মিত সন্তানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলুন, ভিডিওতে তাকে দেখুন! আপনি যদি জেলখানায় না থাকেন তবে সন্তানের সাথে আপনার যোগাযোগ বাড়ানো উচিত। অল্প কয়েকদিন বাদেই এই স্মৃতি আপনার বেঁচে থাকার পুঁজি হবে।
বন্ধুদের সাথে যদি যোগাযোগ কমে যায় তবে বুঝতে হবে ভেতরের মানুষটি পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুদের সাথে নিয়মিত আড্ডা, ভার্চুয়াল যোগাযোগ এসব স্বার্থহীনভাবেই থাকা উচিত। যার বন্ধু নাই সে আসলে জীবনের সুন্দর রূপের সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বন্ধুত্ব তো সেই ভাণ্ডার যেখানে লৌকিকতা ছাড়াই ইচ্ছাগুলো জমিয়ে রাখা যায়। স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে দেয়া যায়। বন্ধু বন্ধুই! তার স্ট্যাটাসের ক্ষুদ্রত্ব কিংবা বৃহত্তর বলে কিছুই নাই। আন্তরিকতাপূর্ণ যোগাযোগ মৃত্যু পর্যন্ত যেনো থাকে! মরণে বন্ধুই যেনো বেশিক্ষণ কাঁদে!
যোগাযোগ বিছিন্নতার ক্ষতি ও শূন্যতা আফসোস করে ঘোচানো যাবে না। জীবন ফুরিয়ে গেলে এর কোনো প্রায়শ্চিত্ত হবে না। আমরা নিজেদেরকে যতখানি ব্যস্ত ভাবি, কৃত্রিমভাবে ব্যস্ত বানাই অতখানি ব্যস্ত হওয়ার সক্ষমতা আসলে মানুষের থাকে না। প্রয়োজন শুধু মানসিকতা এবং আন্তরিকতার!
যে মানুষগুলো আপনার অপেক্ষায় থাকে, আপনার সাথে দু’দন্ড অতিবাহিত করতে ব্যাকুল হয়, আপনাকে বলার জন্য মনে মনে গল্প সাজায় সেই মানুষগুলোর ভাষা হারিয়ে যেতে দিয়েন না! একবার কথা মরে গেলে সেটার আর পুনর্জন্ম হয় না! অন্যের ইচ্ছার মূল্য ও গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের ভালো থাকার স্বার্থেই ঘিরে রাখা মানুষগুলোকে ভালো রাখতে হবে। কাউকে ভালো রাখার জন্য অর্থের চেয়ে সময়ের ক্ষমতা বেশি। যত দ্রুত বুঝবেন ততদ্রুত মানুষের মনের মতো অসীম রাজ্যের বিজেতা হবেন।
raju69alive@gmail.com