ছয় বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। গত রোববার রাত সাড়ে ১২টায় ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেজে কমিটি প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকেই উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। কমিটি ঘোষণার পরপরই হলগুলোতে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া বিভিন্ন গ্রুপের কর্মীরা কক্ষ ভাঙচুর করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক আটকে আন্দোলন শুরু করেন তারা। ডাক দেন অনির্দিষ্টকালের অবরোধের। গতকাল সোমবার সকালে শাটল ট্রেনের লোকোমাস্টারসহ কয়েকজনকে অপহরণ করা হয়। পরে তাদের ছেড়ে দিলেও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। ক্যাম্পাস থেকে ছেড়ে যায়নি শিক্ষক বাসও। সকাল থেকে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে টায়ার জ্বালিয়ে অবস্থান করেন তারা। আন্দোলনের কারণে স্থগিত হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা। ৪২৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েও চবি ছাত্রলীগ সন্তুষ্ট করতে পারেনি কর্মীদের। পদবঞ্চিতরা ৫ দফা দাবিতে অবরোধ অব্যাহত রেখেছেন। ৫ দফা দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলেও জানান তারা। গতকাল বিকাল ৩টায় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এমনটা জানিয়েছেন।
অচল ক্যাম্পাস, বিপাকে শিক্ষার্থীরা : জানা যায়, আন্দোলনের কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, স্পোর্টস সায়েন্স, মেরিন সায়েন্স ও ফাইন্যান্স বিভাগসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরে হওয়ায় শুধুমাত্র চারুকলা ইনস্টিটিউট পরীক্ষা নিতে পেরেছে। ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমীর মুহাম্মদ মুছা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গতকাল সকালে শিক্ষক বহনকারী কোনো বাস শহরের উদ্দেশ্যে যেতে পারেনি। সকালে ঝাউতলা স্টেশন থেকে শাটল ট্রেনের দুই লোকোমাস্টার ও একজন গার্ডকে অপহরণ করা হয়। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও শাটল ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল।
এদিকে আগামী ১৬ তারিখ থেকে শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। এরপর বেশিরভাগ বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা শুরু হবে। এই অবস্থায় ক্যাম্পাসের এমন পরিস্থিতি কাম্য নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের একাংশের ক্ষোভের মুখে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
কক্ষ ভাঙচুর : কমিটির নাম প্রকাশের পর থেকেই হলগুলোতে পদবঞ্চিতরা কক্ষ ভাঙচুর করতে থাকেন। এ সময় শাহ আমানত হলে শাখা সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের কক্ষও ভাঙচুর করা হয়। আলাওলে ১৫টি, সোহরাওয়ার্দীতে ১০, এ এফ রহমানে ৫টি ও আমানত হলসহ প্রায় ৪০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
৫ দাবি, লাগাতার অবরোধের ডাক : পূর্ণাঙ্গ কমিটি পুনর্গঠনসহ ৫ দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন পদবঞ্চিতরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গতকাল বিকাল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এই তথ্য জানান পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ নেতা মো. দেলোয়ার।
তিনি বলেন, কমিটিতে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা হয়নি। রাজপথের নিবেদিত কর্মীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেকে টাকার বিনিময়ে পদ পেয়েছেন। বিবাহিত, অছাত্র, জামাত-শিবির ব্যাকগ্রাউন্ড কর্মীদের, বিভিন্ন অপরাধীদের দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে না থেকেও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নাম এসেছে। এসব কারণে আমরা বঙ্গবন্ধু আদর্শের কর্মীরা শান্তিপূর্ণ অবরোধের ডাক দিয়েছি। কমিটিতে মাঠের প্রকৃত কর্মীদের অন্তর্ভুক্তের আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরোধ থাকবে।
পাঁচ দফা দাবিগুলো হলো, পূর্ণাঙ্গ কমিটি বর্ধিত করতে হবে। ইয়াবা ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস (নতুন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে। সকল অছাত্র, শিবির, বিএনপি-জামাত ও বিবাহিত কর্মীদের ঘোষিত কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। আমাদের ৫০ জন ত্যাগী, মেধাবী ও নিয়মিত ছাত্রকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে আজকের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রদান করতে হবে ও পদবীতে সিনিয়র জুনিয়র ক্রম ঠিক করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া আজাদীকে বলেন, ছাত্রলীগের আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। সেই বিষয়ে আমরা অবগত আছি। আমরা বিষয়টা সমাধানের চেষ্টা করছি।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছি। এরপর কেন্দ্রের অনেকগুলো কাজ থাকে। এটা আমার জানার বাইরে। এখন যারা পদবঞ্চিত হয়েছে তারা যোগাযোগ করুক, যোগাযোগ করে সমাধান করুক।
সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে কল দিলে তিনি কেটে দেন।
এর আগে ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই সর্বশেষ চবি শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর দুই দফায় শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এ পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ১৯ মাস পর ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই চবি ছাত্রলীগের দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কমিটিতে রেজাউল হক রুবেলকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই সদস্যের কমিটি দেয়ার ৩ বছর ১৬ দিন পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেয়েছে চবি ছাত্রলীগ। প্রকাশিত কমিটিতে রাতে দেখা যায় ৩৭৬ জনের নাম। সকালে দেখা কমিটিতে রাখা হয়েছে ৪২৫ জনকে।