আমাদের একটা গৌরব ছিল। সেই গৌরব হলো যৌথ পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধন। আমাদের দেশে যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করার সংস্কৃতি ছিল একটা সময়ে। শুধু পরিবার নয়, পাড়া–প্রতিবেশীরাও একে অপরের সুখে–দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতো যথেষ্ট আন্তরিকতায়। বিপদে–আপদে বাড়িয়ে দিতো হাত সাহায্য–সহযোগিতার। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সেই বন্ধনে এখন ফাটল ধরেছে। ভাঙন ধরেছে যৌথ পরিবারে । যার কারণে সংঘাত লেগে আছে, লেগে আছে সহিংসতা।
গত ২৭ মে দৈনিক আজাদীতে ‘প্রতি মাসে চার খুন, পাঁচ কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বাড়ছে খুনের ঘটনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে চলতি বছর ৫ মাসে ২৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে চারজনের বেশি খুন হয়েছেন। ভাগ্যজোরে বেঁচে গিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছেন আরো তিনজন। সর্বশেষ গত বুধবার টেকনাফে ছোট ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে খুন হন তিনজন। পারিবারিক কলহ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, পূর্ব শত্রুতা, আর্থিক যোগসূত্র এবং বিকৃত মানসিকতা–এ পাঁচটি কারণে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, পারিবারিক কলহ, মাদক, যৌতুক, পরকীয়া, প্রেম, দাম্পত্য সমস্যা, জমি–জমা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করেই অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটছে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে শিশুও। এ সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পরিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষণ্নতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে সমাজে বেড়ে চলছে অপরাধ। সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই ঘটছে এসব খুনের ঘটনা। দিনে দিনে পাল্টাচ্ছে খুনের ধরনও। দিন দিন মানুষ আরো বেশি পাশবিক হয়ে উঠছে। সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ঐতিহ্য পরিবার থেকে সরে যাচ্ছে। নতুন নতুন বিষয় যোগ হচ্ছে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা কমছে। এ অবক্ষয় রোধ করতে পারিবারিক বন্ধন বাড়ানোর পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ কঠোর হতে হবে। এ প্রসঙ্গে সিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার একেএম মহিউদ্দিন সেলিম আজাদীকে বলেন, খুনের যত ঘটনা ঘটছে এর কিছু রাজনৈতিক আর কিছু সামাজিক অস্থিরতা থেকে হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কখন কাকে কে ছুরি মারছে এটা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। আর সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারো নেই। তিনি বলেন, সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে নৃশংস হয়ে উঠছে মানুষ। যে কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ প্রতিটি খুনের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে খুনিদের গ্রেপ্তারে সচেষ্ট রয়েছে। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি খুনের ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
আসলে পারিবারিক বন্ধন ধীরে ধীরে আলগা হয়ে পড়ছে। পরিবারগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। মা–বাবার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন সন্তানেরা। এক পরিবারে থেকেও মা–বাবা ও সন্তানেরা দিন কাটাচ্ছেন যে যার মতো করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন আর আগের মতো দৃঢ় নয়, হয়ে পড়েছে বড়ই ঠুনকো। পত্রিকান্তরে এ বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালিত হয়েছে। তাতে তরুণদের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। তরুণেরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিষয়েই তাঁদের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা বেশি। মা–বাবার সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়ছে। মা–বাবা দুজনেই আয়–রোজগারে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণেই কি দূরত্ব কমছে না, এ প্রশ্নটাও এসেছে জরিপে। সব মিলিয়ে মা–বাবা ও পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে তরুণেরা আগের মতোই বেজায় উদ্বিগ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। মা–বাবা ও সন্তানদের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব কমাতে এগিয়ে আসতে হবে মা–বাবাকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদলে বেশি বেশি সময় দিতে হবে সন্তানদের। গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিও সন্তানদের শেখাতে হবে মা–বাবাকেই।
আধুনিক সময়ে মানুষ যত বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হচ্ছে তত তার আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবও বাড়ছে। সংযুক্ত পরিবার ভেঙে টুকরো হতে হতে নিউক্লিয়ার পরিবারে এসে থেমেছে। একথা অস্বীকার করলে চলবে না, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার পরিবার। কিন্তু আজকাল পরিবারের মধ্যে এমন পারিবারিক বন্ধন দেখা যায় না। সকলেই যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। একই পরিবারে থেকেও পরস্পরের সঙ্গে কথা হয় না। যে যার ব্যস্ততায় জীবনযাপন করে। কারও দুদণ্ড জিরোবার অবকাশ নেই। পরস্পরকে বলার মতো কোনও কথা নেই।
বর্তমানে পরিবারের বন্ধন ব্যাপকহারে ভেঙে যাচ্ছে। এই কারণেই আমাদের সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে চলেছে দিন দিন। আগে এক সময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল যাতে, অসুবিধার তুলনায় সুবিধার দিকটাই ছিল বেশি। সকলেই বিপদে আপদে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেন। ঈদ, পুজো, নববর্ষ যাপন করতেন একসঙ্গে। পারিবারিক খাওয়াদাওয়া, হই–হুল্লোড়– সব মিলিয়ে একটা জমজমাট ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে ছবিটা এর ঠিক উলটো। আর এখন তো দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ পরিবারে স্বামী–স্ত্রীও মিলেমিশে থাকতে পারছেন না। মতবিরোধ আর ইগোর লড়াই শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদে পরিণত হচ্ছে। এ অবক্ষয় রোধ করতে পারিবারিক বন্ধন বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা।