বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৬৬ লাখ মানুষকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ তাঁরা স্থায়ী চাকরি বা কাজের জন্য উপযোগী। কিন্তু নিজেদের পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে কাজ করতে পারছেন না। তবে ভালো কাজ পেলে করবেন। তাই পরোক্ষভাবে তাঁদের বেকার বলা চলে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কেউ এখন পুরোপুরি বেকার, কেউবা টিউশনি কিংবা খণ্ডকালীন কাজ করেন। আবার অনেক শিক্ষিত নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা কাজের উপযোগী হলেও কোনো কাজ করেন না। তাঁদের মধ্যে শিক্ষিত গৃহিণীই বেশি। সংসারের নানা চাপে কিংবা অন্য কোনো কারণে তাঁরা হয়তো আপাতত কাজ করছেন না। অর্থনীতির ভাষায়, এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কর্ম-উপযোগী সম্ভাবনাময় শ্রমশক্তি বলা হয়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনীতিতে উপযুক্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। ফলে সম্ভাবনাময় জনশক্তির অপচয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে, কর্মক্ষম বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে বেকার, খণ্ডকালীন কর্মজীবী এবং সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী-এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করেন, এমন ব্যক্তিদের খণ্ডকালীন কর্মজীবী হিসেবে ধরা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, খণ্ডকালীন কাজ করেন ১৪ লাখ ৬৫ হাজার জন। মূলত টিউশনি, খণ্ডকালীন বিক্রয় প্রতিনিধি, ফাস্ট ফুডের দোকানের বিক্রয়কর্মী, কল সেন্টারের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তাঁরা। পছন্দের কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে তাঁরা এসব খণ্ডকালীন কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। তাই নিজেদের এ কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন তাঁরা। অন্যদিকে কোনো ধরনের কাজ খুঁজেও না পেয়ে পুরোপুরি বেকার রয়েছেন এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। তাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করারও সুযোগ পাননি। এ বেকার শ্রেণিতে নারী ও পুরুষ প্রায় সমান সমান।
বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নত দেশের দিকে হাঁটছে। তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি উন্নয়নের প্রাথমিক ভিত্তি। এর অংশ হিসেবে প্রচুর কল-কারখানা হবে, অবকাঠামো হবে, সুরম্য মার্কেট, শপিং মল হবে, হোটেল-মোটেল হাসপাতাল-বিনোদনকেন্দ্র হবে। প্রচুর কায়িক শ্রমনির্ভর বা ক্লারিক্যাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
এদিকে, করোনাভাইরাস মহামারিতে বিধ্বস্ত অর্থনীতি উদ্ধারে শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরির মতো শিক্ষা কার্যক্রম প্রত্যাশা করেছে ট্রেড বডিগুলো। ‘কোভিড’-১৯ পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্পখাতের প্রস্তুতি : বিনিয়োগ ও দক্ষতা’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনায় এই দাবি করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিপর্যস্ত। বাজার সঙ্কোচনের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্প, এসএমই খাত ও অনানুষ্ঠানিক খাতে বেকারত্বের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দক্ষ শ্রমিকের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোভিড সংকট কাটাতে ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে করতে শিক্ষা কারিকুলামের সংস্কার আনতে হবে এবং শিল্প খাতের চাহিদামাফিক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা লাগবে। বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আনতে হলেও অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। প্রবাস থেকে ফেরত আসা কর্মী এবং স্থানীয় শিল্পখাত থেকে কর্ম হারানো শ্রমিকদের শিল্পখাতে পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে সহযোগিতার আহ্বানও জানানো হয়। বক্তারা বলেন, সমপ্রতি স্থানীয় শিল্প-কারখানার কাজের সুযোগ কমে যাওয়া ও বিদেশ হতে প্রবাসীদের দেশে ফেরত আসার কারণে আমাদের কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থা উত্তরণে অনেকই আত্ম-কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকবে, তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া আবশ্যক। এখন সময় এসেছে ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আরও বেশি মাত্রায় জোর আরোপ করার। দেশের বেসরকারি খাত বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন, যার মাধ্যমে শিল্পখাতের চাহিদামাফিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু এবং দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের শিল্পখাত চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ মানব সম্পদ না থাকায় প্রতিনিয়ত আমাদেরকে বিদেশিদের নিয়োগদানের জন্য অনুমতি দিতে হয় এবং এ অবস্থা উত্তরণে আমাদের শিক্ষা কারিকুলামকে শিল্পমুখী ও যুগোপযোগী করার বিকল্প নেই।