কিশোর গ্যাং নামটা শুনলেই চমকে উঠি এখন। গ্যাং শব্দটাই কেমন ভয়ানক শোনায়। বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই সমাজে এই গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এদের কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এই কিশোর গ্যাং আসলে কারা?
এদের কাজ হচ্ছে মানুষকে উত্ত্যক্ত করা, বকাবকি করা, হুমকি দেওয়া, স্কুল–কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বাজে কমেন্ট করা, মেয়েদের টিজ করা, ভয়ভীতি দেখানো, সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এই বখাটে কিশোররা পড়ালেখা না করে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তারা সাধারণত রাতে দলবদ্ধভাবে থাকে, নেশাদ্রব্য পান করে।
এই দলেই অপরাধের শিকার হয়ে অনেক সন্তান কু‘পথে গিয়েছে, যাচ্ছে। বাবা, মা সন্তানহারা হচ্ছেন, কেউ মা, বোন হারা, কেউ বা বাবাকে হারাচ্ছেন তুচ্ছসব ঘটনায়, এই গ্যাংয়ের দ্বারাই।
আমাদের সময়েই কিশোরদের দল ছিলো। তারা ক্লাব করতো, সংগঠনের কাজ করতো। এই ক্লাব বড়দের আয়ত্তে থাকতো বলে কিশোররা ভয় পেতো। বড়দের সম্মান করতো। অল্পসংখ্যক কিশোর কোনো না কোনো অপরাধ করতো। এদের অপরাধ ছিল অনেকটা এরকম– ছোটখাটো চুরি কিংবা হৈ–হল্লা করা। বড়জনদের হঠাৎ অসম্মান করা, কারো বাগান থেকে আম, পেয়ারা বা ফুল চুরি করা, বা কারো মুরগী নিয়ে যাওয়া। বড় কোনো অপরাধে জড়িত হওয়ার সাহস ছিল না এদের ।
নব্বইয়ের দশকে কিংবা আরো কিছু পরের দিকের সময়ে শিশু–কিশোরদের এহেন অপরাধ মোকাবেলায় সমাজের বয়স্ক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ব্যক্তি ও সমাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ও তাদের ভূমিকা যথাযথ ছিল বিধায় শিশু–কিশোররা অনেকটা ভয়ে বড় কোনো অপরাধ করতে সাহস পেত না। এইসব ছোটখাটো কোন অপরাধ করলে বড়রা ডেকে সমাধান করে দিতো। তারা মেনেও নিতো।
সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে আজ। আমরা কিশোরদের এইসব অপরাধকে এখন কিশোর গ্যাং বলছি। কেননা আজ এই কিশোররা সংঘবদ্ধভাবে এমন সব অপরাধ করছে, যা বয়স্কদের অপরাধকেও হার মানাচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকা, পাড়া কিংবা মহল্লায় তাদের আলাদা নাম রয়েছে। তারা ঐক্যবদ্ধ, তারা সংঘবদ্ধ। বিভিন্ন সময়ে সন্ধ্যা বা রাতে তারা একসঙ্গে অনেকগুলো বাইক নিয়ে প্রচণ্ড শব্দ করে ওভারটেক করে চলাচল করে। তাদের এই চলাচলে কোন রিক্সা বা অন্য যান পথে সাইড দিতে দেরি হলে তারা সকলেই ঐ চালককে মারধর করে। তাদের চলাচল সাধারণ মানুষও ভয়ে থাকে। কেউ কিছু বলার সাহস রাখেনা। কষ্টের কারণ হয়ে দঁাঁড়ায় এইসব। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলারা তাদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ। ফলে তাদের অপরাধের সাথে আর অন্য অপরাধকে আমরা আলাদা করতে পারছি না। শুধু ছোটখাটো অপরাধ নয়, কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাউকে হত্যা করতেও তাদের বুক কাঁপছে না। বড়রা যে অপরাধ করতে দশবার ভাবছে, কিশোররা সে অপরাধ চোখের নিমিষেই করছে। তাদের অপরাধবোধ নেই এসব কাজের জন্য। তারা জানে থানা, পুলিশ কিছু হলেই রাজনৈতিক বড় ভাই আছেন।
আমাদের উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। মাননীয় হাইকোর্ট সমপ্রতি আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা কোনো অপরাধের ধরন, কারণ বিশ্লেষণ, বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী বলে মনে করি।
আমাদের পারিবারিক শিক্ষা আর আগের মতো নেই। আমরা কেউ কেউ সন্তানদের সঠিক মূল্যবোধ শেখাতে পারছি না বা শেখাতে চেষ্টাও করছি না। পরিবারের বাইরে সামাজিক নিত্যনতুন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় গড়ে উঠছে, কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে কাজের ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ফলে শিশু–কিশোররা সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে বড় হতে পারছে না।
আমাদের পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। লাইব্রেরি নেই। আগে পাড়ায় পাড়ায় সংগঠনের উদ্যেগে যে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হতো সেসব একেবারেই নেই বললেই চলে। এইসব সাংস্কৃতিক সংগঠন বেশি করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা সংগঠিত হয়ে ক্লাব করে ওখানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংস্কৃতি চর্চা করলে পাড়া থেকে দূর হতো অপরাধ। পাড়া থেকে মহল্লায়, মহল্লা থেকে এলাকায়, এলাকা থেকে দেশ ধীরে ধীরে অপরাধ প্রবনতা দূর হতো।
বই জ্ঞানের ধারক। বই জ্ঞানের আলো। বইয়ের সাথে মন ও শরীরের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। বই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এদেশের শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে বইবিমুখ। তারা এখন ইন্টারনেটের সহায়তায় নানান গেইম খেলা, নতুন নতুন অপরাধের ধরন শিখছে। অথচ আমাদের সময়ে গল্পের, কবিতার বই, সাহিত্যের বই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া হতো। নিজের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি এসব বই ঘরে থাকতো। এমনকি স্কুলেও লাইব্রেরি ছিলো। ওখান থেকে বই পড়ার নির্দেশ ছিলো। কে কটা বই পড়ে জমা দিয়েছি, স্কুলে লিস্ট থাকতো। এই বইবিমুখতা কিশোর গ্যাংয়ের অন্যতম কারণ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও আজ ভীষণ অসহায়। কেননা কোনো শিক্ষার্থী অন্যায় কাজ করলে কিংবা আচরণ প্রতিরোধ করতে গেলে তাঁদেরও হুমকি দিয়ে রাখে। এমনকি জীবনহানি ঘটতে পারে বা ঘটেছে। সবচেয়ে বড় ভুল এই শিক্ষকদের কাছ থেকে শাসন উঠিয়ে নেয়া। স্কুল হলো আমাদের কাছে মা, বাবার পরের স্থান। মা,বাবাকে যতটা ভয় পেতাম না শিক্ষকদের ভয়ে তটস্থ থাকতাম সবসময়ে। কারণ শাস্তি।
শিশু–কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তা বেশি। পরিবারের পরেই বেশি অবদান রাখে খেলার মাঠের সঙ্গী–সাথীরা। বাড়ির পাশেই মাঠ থাকতো। কার সাথে মেলামেশা করছে তা পরিবার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে কংক্রিটের স্তূপে চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে খেলার মাঠ। হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের স্বাভাবিক জীবন।
রাজনৈতিক পরিচয়কে বর্তমানে বিবেচনায় আনা হচ্ছে নেতৃত্বদানের। ফলে ভালো কাজ করার মানুষগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে মানসম্মানের ভয়ে । রাজনৈতিক বড় ভাই যারা, তারা শিশু–কিশোরদের দিয়ে ভালো কাজ করা কিংবা তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পরিবর্তে শেখাচ্ছে পারস্পরিক রেষারেষি এবং নিজেকে জাহির করার মানসিকতা।
কিশোর গ্যাংকে কোনো একক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ নেই। পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, আইন ও আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
এই কিশোর গ্যাংয়ের বড় ভাই, ছোট ভাই আছেন। আমাদের সমাজে ‘বড়ভাই’ ও ‘ছোটভাই’ কালচার গড়ে উঠেছে। তাদের মাধ্যমে এই কিশোররা অপরাধের জগতে পা বাড়িয়েছে। অপরাধ করলেই বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় এই কিশোররা দলবদ্ধ হয়ে অপরাধ করেই যাচ্ছে। তারা কাউকে তোয়াক্কা করছেনা। এমন করে চলতে থাকলে দেশ যে কোন পথে যাবে তা একটা সময়ে টের পাবেন রাষ্ট্র।
রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে স্বাভাবিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করুন। শিশু–কিশোরদের ব্যবহার করে নয়। তাহলে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।