অপরাধ এবং অপরাধমূলক ঘটনা অসাম্যের সমাজে ওতপ্রোতভাবে নিত্যসঙ্গী। অতীতে রাজধর্মের মত পুলিশ প্রশাসনের কর্তব্য খাতায়–কলমে আছে–দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। আদতে তার অর্থ দাঁড়ায় শিষ্টের দমনে দুষ্টের পালন। তার উপর সরকার যদি দুষ্টলালিত ও দুষ্টপালক হয় তাহলে পুলিশ আরও এগিয়ে যায় দুষ্টরক্ষায়। আইনে–সংবিধানে সব সময় থাকে রাষ্ট্র শ্রেণীর ঊর্ধ্বে–অর্থাৎ গরিবদের পক্ষেও নয়,বড়লোকদের পক্ষেও নয়। আর্থিক ক্ষমতা বড়লোক বা ধনীশ্রেণীর হাতে, তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও আসলে তাদের হাতে। এই দুষ্ট ক্ষমতাই দুষ্টের জন্ম দেয়, লালন–পালন করে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই গড়ে উঠে, এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। সমসাময়িক পরিস্থিতির উপর দমনপীড়ন কীভাবে এবং কতটা মাত্রায় বিরাজ করবে তা নির্ভর করে । কী সহজে অল্প সংখ্যক লোক অনেকের উপর শাসন চালিয়ে যাচ্ছে এবং কীভাবে মানুষ তাদের ভাগ্যকে ওই মুষ্টিমেয়র উপর সমর্পণ করছে, তাতে প্রায় আড়াইশো বছর আগে স্কটল্যান্ডের দার্শনিক ডেভিড হিউম বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কী নৃশংস ভয়ঙ্করতায় এই আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটছে, শাসকদের প্রতি বাধ্য ও অনুগত থাকা সুনিশ্চিত করতে জনমতকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়,হিউম কেন,আড়াইশো বছর পরেও তা অধিকাংশের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অবাধ্য থাকলে বলপ্রয়োগের ঘটনাও চিরন্তন।
একটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যখন এই প্রক্রিয়া চলে, তখন বৃহৎ ধনীদের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ধনীরাও নিস্কৃতি পায় না আরও স্বার্থের হানাহানিতে। গোটা সমাজটাই নিষ্পেষিত হয় এই যন্ত্রে। এভাবে বহমান আর্তিক শক্তিধর রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্টকেও কবলিত করে। ইউরোপীয় ধনিক–বণিকরা রাজশক্তি এবং অস্ত্রশক্তির জোরেই হিউমের জীবদ্দশার আগে থেকে এ কাজ শুরু করে। আজও তা–ই। দুনিয়াজুড়ে অগণিত নজির ও ঘটনা, রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে শক্তিধররা করে চলেছে। পরধীনতা কেউ মেনে নেয়নি,তা চাপানো হয়েছিল। কিউবার ওপর অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আমেরিকা,সঙ্গে ছিল ইজরায়েল এবং উজবেকিস্তান। প্যালেস্টাইন নিয়েও তা–ই। এসব তথ্যও অনেক। কিন্তু পৃথিবীর মূল প্রচার মাধ্যমে কখনই স্থান পায়নি এসব সংবাদ। জনমতকে চাপা দেবার আধুনিকযন্ত্র আজকের শক্তিধররা প্রয়োগ করে চলেছে। ইরাক,আফগানিস্তান, সিরিয়া,সুদান,ইয়েমেন প্রধানত লাইনে দাঁড়িয়ে ইরান এবং আরও আছে।
গোটা লাতিন আমেরিকাজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা নাশকতা, সন্ত্রাসবাদ এবং সে সব দেশের স্বৈরাচারী সামরিক আধা–সামরিক রাজত্ব এবং বাহিনীকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে। লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশে লুটের মৃগয়াক্ষেত্র তৈরি করেছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে নাশকতা ও আগ্রাসী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে।৭০–র দশকে নিশিদ্ধ ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে কলম্বিয়ায় নৃশংস বর্বরতা চলে। মাদকচালানকারী,জমিদার, সামরিক বাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী এক জোট হয়ে সেখানে চালায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী,নেতা, এমনকি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকেও খুন করা হয়। কলম্বিয়ায় স্থায়ী গণতন্ত্র আছে বলে আমেরিকা তাকে ভূষিত করে। ব্রাজিল,আর্জেন্টিনা,গুয়াতেমালা,এল–সালভেদোর– সর্বত্র একই চিত্র। প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ লাতিন আমেরিকার মানুষ সীমাহীন দারিদ্র ও বর্বর সন্ত্রাস ভোগ করতে থাকে।
পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলেও শোষণ–নির্যাতন থেকে বাংলাদেশবাসীরা মুক্ত হয়নি। তবুও স্বাধীন দেশ কৃষি অর্থনীতি গড়ে তুলতে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল,বিশ্বের বাজারদরের উঠানামা থেকে এই অর্থনীতি সুরক্ষা দিয়েছিল, ঋণসহ কৃষি উপকরণে ভরতুকি বাড়িয়েছিল। কিছুটা লাভজনক দাম দিয়ে খাদ্যশস্য সরকার সংগ্রহ করেছিল, সেচ ও পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠে কৃষি গবেষণা। এসব ব্যবস্থার সাফল্য কৃষকদের সব অংশের মধ্যে সমানভাবে বন্টিত হয়নি। ধনীরা লাভের গুড় সকারি সহায়তায় লুটে নেয়। তবুও এই অর্থনীতি বৃহৎ বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি এবং বৃহৎ পুঁজিপাতি কর্পোরেট পরিবারগুলোর আগ্রাসী ভূমিকাকে রোধ করার উপায় হিসাবে বিরাজ করছিল। শিল্প পুঁজিপতিদের অত্যধিক আঘাত থেকেও শ্রমিকদের স্বার্থ কিছুটা হলেও সরকার রক্ষা করার চেষ্টা করত। দেশি–বিদেশি বৃহৎ পুঁজিপতিদেরই স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত ছিল না। এটাকেই কেউ কেউ ‘সমাজতান্ত্রিক’ পথ কিংবা অধনতান্ত্রিক পথ বলে ভূল করেছিল, যদিও সরকার এবং রাষ্ট্র মূলত বুর্জোয়া–জমিদারেরই ছিল।
সাম্রাজ্যবাদী নয়া–উদকীরণ এবং সম্পূর্ণরূপে বাজার নির্ভর আর্থিক নীতি রাষ্ট্রকে পুরোপুরি দেশি–বিদেশি বৃহৎ পুঁজির স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত করে। শ্রমিকশ্রেণী,কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ঘোষিত হয়, মুখে আম–আদমি বা সাধারণ মানুষের কথা যতই তারস্বরে প্রচার করা হোক। দীর্ঘ বছরে নয়–উদারনৈতিক সংস্কারের ‘প্রকৃত সাফল্য’(!) হল: খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতা, কর্মসংস্থানহীনতা, চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি না–করা, সামাজিক সুরক্ষার ঢালাও ছাঁটাই, কৃষি ও ক্ষুদ্র উৎপাদনে সহায়তা হ্রাস, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সরকারি গবেষণা উৎখাত,বীজ–সার–কৃষি ব্যবসা খুচরা ব্যবসা বিদেশি এবং বৃহৎ পুঁজির লুটের জন্য তুলে দেওয়া, মহামারির মত অপুষ্টি বৃদ্ধি। নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তরাও কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন।
সরকারের হিসাবে উচ্চধনী বা সুপার ধনী যাদের বাৎসরিক আয় কোটি টাকার উপরে এদেশে তাদের সংখ্যা লাখের উপর। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পত্তি হিসাব সমীক্ষা সংস্থার হিসাবে ৫.৫ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগযোগ্য অর্থ এবং অন্যান্য বাড়ি ও স্থাবর সম্পত্তির মালিকের সংখ্যা দেশে কয়েকশত। অন্যান্য দেশের তুলনায় এদের ট্যাঙ কম মাত্র ৩২.৫ শতাংশ। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫০০ কোটি টাকার বেশি আবগারী কোম্পানিগুলো এই ট্যাক্সও দেয় না, দেয় মাত্র ক’জন। যদি সব কর্পোরেট মালিকদের কাছ থেকে বিধিবদ্ধ ট্যাক্স সরকার আদায় করে তাহলে চলতি বছরেই সরকারের আয় হতে পারে বাড়তি কয়েক হাজার কোটি টাকা।
আগের এই বিরাট ব্যবধানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি–কেলেঙ্কারি। এই বিপুল পরিমাণ বৈধ–অবৈধ অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে সংসদীয় নির্বাচনে, সমাজবিরোধী অবিশ্বাস্য রকমের অপরাধমূলক কাজে এবং আগ্নেয়াস্ত্র মজুতে। উদারনীতির ব্যবাস্থা চাপিয়ে দিতে সরকারি স্তরে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বাড়ছে, জনমত ও সংসদীয় রীতিনীতিকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হচ্ছে। এই প্রবণতা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনকে গ্রাস করতে চলেছে।
যত্রতত্র কথায় কথায় গুলি–বোমা,আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ নিরীহ ও শিষ্ট মানুষের উপর চলছে জোরজুলুম। ধনী–ব্যবসায়ীরাও অনেক ক্ষেত্রে নিয়োজিত করছে সমাজবিরোধী বাহিনীকে। এই ধনী ব্যবসায়ী,কালোবাজারি সমাজবিরোধীরা আশ্রয় নিচ্ছে রাজনৈতিক দলে। এমনকি আঞ্চলিক দলগুলোও ক্ষমতার জন্য এদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
বহুকাল আগে শোনা যেত,আমেরিকা আগ্নেয়াস্ত্র ও অপরাধের দেশ। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ মানুষের নিরাপত্তা দিতে অসহায়। আত্মরক্ষার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র রাখাটা অনেকটা বৈধ রূপ পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে আমেরিকায় জন লট ‘বেশি বন্দুক কম অপরাধ’ বই লিখে ঝড় তুলেছিলেন। অনেকে ছিলেন পক্ষে, অনেকে বিপক্ষে। সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে সাত কোটি আগ্নেয়াস্ত্র বিপক্ষে বেসরকারি হাতে আছে তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। জনসংখ্যার অনুপাতে বেসরকারি আগ্নেয়াস্ত্র রাখার ব্যাপারে আমেরিকার পরেই হয়ত আমাদের এই ক্ষুদ্র দেশ।
দেশে বিচ্ছন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বাইরে প্রতি বছর ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রে প্রাণ দিতে হচ্ছে গড়ে ক’হাজার মানুষকে। সরকারি হিসাবে কম হলেও খুন হচ্ছেন বহু মানুষ। এ কেবল সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও বিপজ্জনক। আরও উদ্বেগের বিষয় বেশ ক’জন সংসদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ আছে। যেমন–খুন,ধর্ষণ,অপহরণ,জমি–সম্পত্তি–অর্থলুট। এই ব্যাধি সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ, দেশি–বিদেশি বৃহৎ ধনী,পুলিশ প্রশাসনের উচ্চস্তরের মধ্যে যে লুটেরা–জোট গড়ে উঠেছে, সেটা দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কাজের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।
এভাবেই চলছে নয়া উদারীকরণের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে রাজনীতির এই অপরাধীকরণ এবং অপরাধের এই রাজনীতিকরণ। এই নয়া–উদারীকরণ গণতন্ত্রকে ক্রমাগত খর্ব করে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কতটা নির্মম সত্য বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন লেখক ম্যাসন কোলে’র এই বক্তব্য-‘ঐশ্বর্যই তৈরি করে আইন যা মেনে চলতে দারিদ্র্য বাধ্য’।
লেখক : সাংবাদিক–কলামিস্ট।